১৯ এপ্রিল ২০২০
ডা. শুভদীপ চন্দ
ঢাকায় এক রিকশাদার ছিল। ত্রিশের কোটায় বয়স। আমাকে বলেছিল টাকা জমাচ্ছে মুদি দোকান দিবে। বলেছিল- ‘এভাবে ঘুরেফিরে রোজগার করতে ভাল লাগে না। একখানে বসমু- চারপাশে চাল ডাল থাকবে, বৈয়ামে বিস্কুট থাকবে, কেক থাকবে। সুগন্ধি সাবান থাকবে। সব তাকে সাজায়ে রাখমু। মাল বেচুম আর টিভি দেখমু।’
এখন এই রিকশাচালক কোথায় আছে কে জানে। আমাদের চা খাওয়াতো- ছাপড়া দোকানদার হুমায়ুন, কাল দেখলাম আলু পটল বাটখারা নিয়ে বসেছেন। হাসপাতালের সামনে আতর টুপি বিক্রি করতো এক চাচা, এখন মাস্ক বিক্রি করেন। ক্লিনিকগুলো সব স্টাফকে নন পেয়িং লিভ দিয়ে দিছে। ক্লিনিকের এক ওয়ার্ডবয় বাসায় বাসায় গিয়ে সার্ভিস দিচ্ছে। কারো এনঅক্সাপারিন ইঞ্জেকশন, কারো সেফট্রিয়াক্সন ইনজেকশন। ‘ভাই ভাই সেলুন’ এর নাপিত এখন ফুড পান্ডার ফুড ট্রান্সপোর্টার।
সারভাইভ- যেকোনো কঠিন সময়ের একমাত্র কাজ। এবং সে-ইই পারে যে বদলাতে জানে।
আজ মনখারাপ নিয়ে দেখছিলাম শহরের মূল রাস্তার দু’পাশের দোকানপাট। ফার্নিচারের দোকান, জুতার দোকান, স্মার্টেক্স, মাম্মিজ এন্ড বেবিজ, মোবাইল শপ, ইদ্রিস ইলেকট্রনিকসের দোকান- সব বন্ধ। স্কুলের পাশে গেলে আরো বেশি খারাপ লাগে৷ মনেহয় ঘুমন্ত রাজপুরী। আমার বাসার সামনের বাসাটিই মেস। কিছু স্কুল কলেজের ছেলেরা থাকতো। ছাদে লুকিয়ে সিগ্রেট টানতো। সব বন্ধ। জানালা নেভানো, ভিতরে আর কাউকে পড়তে দেখা যায় না।
একমাত্র ভীড় সুপার শপ গুলোয়। দুই তিন ট্রলি এক মানুষ একা টানছে। এর মাঝেও কামিজ পাঞ্জাবি চুজ করছে! এ শপটিতে এসবও আছে। সৌখিন কেক বানানোর ভুংভাং খুঁজতে গেছিলাম- কিচ্ছু নেই। ভিনেগার নেই। কিছু মানুষ ছুটিটাকে উপভোগ করছে। রান্নাবান্নায় দক্ষতা বাড়াচ্ছে। সাজসজ্জায় নতুনত্ব আনছে।
হাসপাতালে রোগী নেই। এরমাঝেও কেউ কেউ আসেন- যাদের আসার প্রয়োজন নেই। কনভার্সন ডিজঅর্ডার একমাত্র অসুখ যার উপর লকডাউন কোনো ইমপ্রেশন রাখতে পারে নি। আমার ধারনা গত একমাসে আমাদের ভর্তি রোগী নিয়ে স্টাডি করলে কোনো হার্ট-লাঙ-কিডনি ডিজিজ পাওয়া যাবে না। সব হালকা মানসিক সমস্যা। কিছু মারামারি। মারামারির রোগীদের এক হীনমন্যতা আছে যে ভর্তি থাকলে কেস পোক্ত হবে। সেজন্য জোর করে ভর্তি থাকেন। অন্যের ক্ষতি করার সুযোগ দেখলে বাঙালি করোনাভাইরাসকেও ভয় পায় না!
ডিসইনফেক্টেন্ট নিয়ে কথা হচ্ছিলো। এতোদিন আমরা হাসপাতাল ডিজইনফেক্ট করি নি। পিপিই, মাস্ক নিয়েই ভাবতে ভাবতেই এ গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টটি মিস করে গেছি। কিভাবে কী করা যায় ভাবতে ভাবতে জানা গেল আমাদের স্টোর রুমেই ৬টি স্প্রে মেশিন আছে। পোশাকও আছে। কালাজ্বরের জন্য আনা হয়েছিল। স্টোর কিপার জানেন না! অক্সিজেন ১২ টি সিলিন্ডারই ভর্তি করে আনা হয়েছে। আরো বেশি থাকলে ভাল হতো। কখনো কখনো ছোটখাটো জিনিস যুদ্ধক্ষেত্রে অনেক বেশি কাজে দেয়। একবার শুধু আম্বো করেই এক রোগীকে ফিরিয়ে এনেছিলাম। রোগীর লোক ডিএনআই ডিএনআর সাইন করে বসেছিল।
আজ শুনলাম করোনাভাইরাস প্রতিরোধে বাজেট আসছে- সেটা ইউএনও’র কাছে। সরকারি রীতিনীতি আমি খুব ভাল বুঝি না, প্রশ্ন তোলাও সমীচীন নয়। কিন্তু আমার মনে হয় স্বাস্থ্যখাতকে গড়ে তুলতে গেলে প্রথমে তাদের এডাল্ট হওয়ার সুযোগ দিতে হবে। অর্থ খরচ করার স্বাধীনতা ও সাহস তাদের বাধ্য করবে দায়িত্বশীল আচরণ করতে। বারবার সহযোগিতা নিয়ে কেউ বড় হতে পারে না। প্রশাসনের সহযোগিতা, সেনাবাহিনীর সহযোগিতা, পুলিশের সহযোগিতা- এতো সময় তো এখন নেইও। আমার ধারণা আমাদের উপজেলায় ঠিকমতো স্যাম্পল কালেকশন করতে পারছে না। ভিডিও লার্নিং বা টেলিমেডিসিন- এ দুইয়ের কোনোটিতেই আমার খুব বেশি আস্থা নেই।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আজ কেউ একজন মারা গেছেন। তার জানাজায় হাজার হাজার লোক জমায়েত হয়েছে। এটি খুব খারাপ হলো। কখনো কখনো একজন নাবিকের একটি ভুল পুরো জাহাজটিকেই ডুবিয়ে দিতে পারে।
আজ সকাল থেকেই দমকা বাতাস। সূর্য মেঘের লুকোচুরি খেলা চলেছে সারাদিন। বৃষ্টি হয় নি। মনেহয় আশেপাশে কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে। বাজারের পাশে এক মাঁজা পুকুর। কোনদিন ব্যবহার দেখি নি। শ্যাওলা দিয়ে সবুজ হয়ে থাকতো। কাল দেখলাম কচুরিপানা পুরো পুকুরের দখল নিয়ে নিছে। তার মধ্যে ফুল ফুটেছে। নীল নীল ফুল। কচুরিপানা ফুল সুষম বন্টনে ফোটে না। পুষ্কুনির কোথাও বেশি, কোথাও কম। সবুজের উপর নীল- যেন রাতের কালো আকাশ আর আকাশভর্তি তারা।
আকাশ থেকে যিনি দেখেন তিনি কতই মুগ্ধ হয়েই না এ পুকুর দেখেন; আমরা পাত্তা দেই না। ঈশ, যদি উড়তে জানতাম আমি এ পুকুরটার উপর দিয়েই উড়তাম!
আরেকটি দিনের শেষ।