২৬ এপ্রিল ২০২০
ডা. শুভদীপ চন্দ
এ করোনার সময়ে ভারতে বিস্ময়কর ভাবে মৃত্যুহার কমে গেছে। একটি রিপোর্টে দেখলাম- ২০২০ সালের মার্চ মাসে ২০১৯ সালের মার্চ মাসের তুলনায় মুম্বাইয়ে মৃত্যু ২১ শতাংশ কম। আর আহমেদাবাদে ৬৭ শতাংশ কম। দুর্ঘটনা, খুন, ড্রাগ, এলকোহলের মৃত্যু তো কমেছেই, এমনকি হার্ট এটাক বা স্ট্রোকে মৃত্যুও কমে গেছে।
অর্থাৎ মানুষ মরতেও ভয় পাচ্ছে! ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ একবার বলেছিলেন, সংসার হচ্ছে উটের কাঁটা ওয়ালা গাছ খাওয়ার মতো, পেট ভরে ঠিক কিন্তু ঠোঁট মুখ সব রক্তাক্ত করে ফেলে। হাসপাতালে আসলে এ কাঁটাগাছের উদাহরণ আরো ভাল বোঝা যায়। ডাক্তার রোগী সবার এটিটুড হচ্ছে- আসতে হচ্ছে বলে আসছি নইলে এ ঠোঁটে কখনো রক্ত ঝরতে দিতাম না। সবাই সবার মধ্যে করোনা দেখছে। নন টাচ মেথডে চিকিৎসা দেয়া আমাদের এক বড় সমস্যা ছিল। সে আরো ভাল করে শাখা প্রশাখা সহ প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। এখন রোগীর গায়ে হাত না দিলে কেউ দোষ ধরে না। প্র্যাগনেন্সির কথাই ধরুন। কষ্ট কমাতে গিয়ে লেবার রুমই হারিয়ে যাচ্ছে।
এক রোগী আসলো নীল কালিতে ‘ভিক্ষুক’ সিল নিয়ে। মাস্ক টাস্কের বালাই নেই, দূরত্ব মেনেই দাঁড়ালো। এ ‘ভিক্ষুক’ সিল, ‘সচিব’ সিল, ‘প্রাইমারি শিক্ষক’ সিল, ‘চেয়ারম্যানের লোক’ সিল- শুধু আমাদের দেশেই সম্ভব। এখানে চিকিৎসা রোগ অনুসারে সাজানো হয় না, স্ট্যাটাস অনুসারে সাজানো হয়। আমাদের প্রফেসরকেও দেখেছি ক্ষেত্রবিশেষে সামান্য কাশির হিস্ট্রি এতো গুরুত্ব দিয়ে নিতে, যেন উনি দুষ্প্রাপ্য কোনো রোগের তত্ত্বতালাশ করছেন। যেন এর আগে এ দেশে কাউকে কোনদিন কাশতে শোনেন নি! যাইহোক ভিক্ষুক সাহেব এতো কমপ্লেন করলেন, এতো কমপ্লেন করলেন- শুধু কমপ্লেন লিখতেই ওরকম কাগজ চারটি লাগবে। সরকারি ব্যবস্থাপত্র সবসময় ছোট কাগজে হয়। ভাবলাম বলি ‘সরকারি কোষাগার আপনার থালা নয় যে হাঁ মেলে থাকবে…’। তারপর ভাবলাম ধুর, অহেতুক কথা না বাড়াই। ভিক্ষুকের করোনা ফরোনা নিয়ে চিন্তা নেই। তিনি জন্ম থেকেই ইমিউন। একমাত্র মানুষের কৃপণতাকে ছাড়া তিনি আর কোনো কিছুকেই ভয় পায় না। বরং উল্টো ন্যাংটাকে ঈশ্বরও ভয় পান!
কিছু রোগী আছে জোর করেই ভর্তি হয়। দুইদিন হাসপাতালের খাবার খায়। ফ্রি ঔষধ খায়। মানে একটু চেঞ্জের জন্য আসে। সেরকম এক রোগী এসেছে। পেটের ব্যাথা ডানে বামে সরতে সরতে বিছানায় চলে গেছে। আমার এক কলিগ দেখছিল, বললো- ‘ভর্তি তো দিচ্ছি, তবে উপরে কিন্তু করোনা আছে’। মহিলার চেহারাটি হলো দেখার মতো। অবিশ্বাস, বঞ্চিত আর প্রতারিতের মুখ। যেন বলছে- ‘হ্যাঁ এটুকুই বাকি ছিল! এতো কষ্ট করে আসলাম, এতো গল্প বানালাম, এখন বলছো জানের জিম্মা আমার?’ হাসপাতালে সব হাসি কান্নার একটি করে নিজস্ব গল্প আছে। দেখা হয় না, শোনাও হয় না। মহিলা পালালেন কৃমিনাশক নিয়ে। যাতায়াতের কষ্টটা তো উঠাতে হবে!
আজকাল আড্ডা কমে গেছে। চাঙ্গা থাকতে মোটিভেশনাল কলাম পড়ি। মোটিভেশনাল লেখা গুলো ভাল। সব আবহাওয়ার জন্যই লেখা হয়। আগে বলতো ‘যে পজিশনে আছো সে পজিশনে থাকার জন্য আরো জোরে দৌড়াও’; এখন বলছে ‘যদি বেশিদূর যেতে চাও তো ধীরেধীরে হাঁটো’! কি করব বুঝতে না পেরে বসে থাকি।
আমার আজ চব্বিশঘণ্টা ডিউটি চলে। আমরা এখন একদিন পুরো ডিউটি করে, পরেরদিন নেশাখোরের মতো ঘুমাই। কষ্ট হচ্ছে সময় পার করানো। এক ছোট ভাই বুদ্ধি শিখিয়েছে- চব্বিশঘণ্টায় আটচল্লিশটি টালি কাটবেন। তারপর প্রতি আধাঘন্টা পর পর একটি করে টালি ক্রস দিয়ে দিবেন।
তাই করছি। জিনিসটাতে কাজ হয়। আসলে ‘মন্দ সময়টা যাচ্ছে’- এ ফিলিংসের চেয়ে আনন্দদায়ক আর কিছু নেই। এক টালি কেটে দিলাম মানে আধাঘন্টা পার হয়ে গেলো। আরেক টালি কাটার দায়িত্ব নিয়ে আরো আধাঘন্টা পার করা যায়।
আমাদের আধা ঘন্টা আধা ঘন্টা করে বেঁচে থাকা, আমাদের একদিন একদিন করে বেঁচে থাকা।