প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ৪ জুন ২০২০, বৃহস্পতিবার
ডা. শুভদীপ চন্দ
মায়েরা সাধারণত তাদের সন্তানকে বাম কোলে নিয়ে বুকের দুধ খাওয়ায়। এটা শুধু এর জন্য না যে বেশিরভাগ মা ডানহাতি। ডান হাত ফ্রি করে দেয়। এর কারন আমাদের হার্ট বাঁ পাশে থাকে। ছোট বাবুরা যখন বাম কোলে মাথা দেয়- তারা মা হার্টের ধুকধুকানি শোনে। শান্তি পায়। যে শান্তি নিয়ে তারা এতোদিন মায়ের পেটে বসে ছিল। বাঁহাতি মায়েরাও শিশুদের বাঁ কোলে নেন। শিশুদের কোলে নিয়ে দুলে দুলে হাঁটলে তারা ঘুমিয়ে যায়- এর পিছনেও একই লজিক।
আমরা এক রিদমে অভ্যস্ত হয়ে গেলে সেখানেই থাকতে চাই- তা সে যেমনই হোক না কেন। লকডাউন আমাদের এক স্লো রিদম দিয়েছিল। আমরা নিজেকে নিজের মতো মানিয়ে নিয়েছিলাম। রান্না বান্না, সোশ্যাল মিডিয়া, বই পড়া, রাজেশ্বরীদের গল্পে কান পেতে রাখা। এমনকি জিম বা সেলুনের অভাবও আমরা মিটিয়ে নিয়েছিলাম। এ জীবন থেকে সে পুরনো জীবন বেশি আপন হলেও ফিরতে ইচ্ছে হয় না।
এটি প্রমাণ করে মানুষ সবচেয়ে বেশি ভয় পায় অজানাকে। আমরা যখন লকডাউনে যাই তখন আক্রান্ত একশোর নিচে ছিল, আজ যখন আনলক হচ্ছে আক্রান্ত পঞ্চাশ হাজার ছুঁইছুঁই। কিন্তু এর বিপক্ষে যুক্তি তেমন জোরেশোরে উঠছে না। কারন আমরা সবাই বুঝতে পারছি- এটি সম্ভব না সারাজীবন করোনা সেন্ট্রার্ড জীবন যাপন করা। সাথে এও জানি এদেশে স্বাস্থ্যবিধি কেউ মানবে না, সুতরাং বহু দুর্ভাগ্য এখনো দেখা বাকি। লকডাউন আমাদের কিছু ছবি দিয়েছে। ইতিহাসে এ ছবিগুলো সংরক্ষিত থাকবে। শহরগুলোর শুন্য রাজপথ, পিপিই পরে লাশ দাফন, টেস্টের জন্য অপেক্ষা করতে করতে ফুটপাতে ঘুমিয়ে পড়া, ভারতে মাইগ্রেন্ট শ্রমিকরা হাঁটছে শত শত মাইল, দুই বছরের বাচ্চা তার মৃত মায়ের ঘুম ভাঙ্গানোর চেষ্টা করছে…। আর কত কী!
Q- বর্নের কুইন ছাড়া আরেকটি শব্দ যোগ হলো, কোয়ারেন্টাইন। মেয়ে সৌন্দর্য তার মুখশ্রী বা পোশাকে নয়, থাকে তাকে ঘিরে থাকা ঘনীভূত দূরত্বে। সে দূরত্ব চোখ রাঙ্গিয়ে বলে- পুরুষ, শুধু তোমাকে নয় তোমার চোখকেও অনুমতি নিতে হবে- কাছে ঘেঁষতে চাইলে। অনেকদিন পর দেখা। জিজ্ঞেস করি ‘কেমন চলে দিনকাল। ফুফাতো ভাইটির কি খবর?’ বলে ‘বাদ দাও, সে অনেক বড় গল্প’। কোনো গল্প কী আছে যে অনেক বড়? গল্প দুইরকম হয়- ছোট গল্প ও ‘বাদ দাও গল্প’! মানুষ বলে না, কারন সে বলতে চায় না। সময়ের অভাব কোথাও নেই। আমিও আর জোরাজোরি করি না। কাগজের নৌকা বানিয়ে রেখে দেই। এ নৌকায় পানি নেই, মাঝি নেই, যাত্রী নেই, পাল নেই, ভেসে চলা নেই, গন্তব্য নেই, ঘাট নেই। নিশ্চল পড়ে থাকে, বুকের মাঝে থাকা যন্ত্রণা গুলোর মতো।
এদিকে আমার ডিউটি চলছে। দশ দিন ডিউটি, তারপর কোয়ারেন্টাইন। রোগী বাড়ছে হু হু করে। গ্রামাঞ্চলের মানুষ কখনোই খুব বেশি সচেতন নয়। তারা আইন মানে, কেন মানে সে না জেনেই মানে। বিকেলে বাইক নিয়ে বের হই। আমি বাইক চালাতে জানি না। পেছনের সিটে বসে থাকি।
দূর দূরান্তে গ্রামের মধ্যে চলে যাই। পাশাপাশি রতনগঞ্জ কিন্ডারগার্ডেন ও রতনগঞ্জ মাদ্রাসা দেখি। দুই পাশে ধানক্ষেত মাঝ বরাবর রাস্তা। কৃষকরা ধান কেটে আঁটি বানায়। তারপর অদ্ভুত ভঙ্গিতে ভারসাম্য রেখে রেখে হেঁটে সেগুলো রাস্তায় এনে রাখে। কখনো আনে নৌকা বয়ে। ধান মাড়াই করে, খর রাস্তায় বিছিয়ে দেয়, কুলা দিয়ে কুড়া ঝাড়ে। রাস্তা কেন্দ্রিক জীবন। পুরো পরিবার এখানে, জীবন যাপনও এখানে। ধানের সুন্দর গন্ধ পাওয়া যায়। গাছে গাছে কাঁঠাল ঝুলতে দেখি। কোনো কোনো গাছে অসংখ্য কাঁঠাল। বৃষ্টি হয়। ঘরে ছোট ছোট লাল ট্রেনের মতো ক্যারা ঢুকে। মেঝেতে গড়িয়ে গড়িয়ে এগোতে থাকে। আগে ঘৃণা হতো। এখন হয় না। কোভিড একটি শিক্ষা দিয়ে গেছে- এ পৃথিবীটা যেমন আমাদের, এ পৃথিবীটা ওদেরও। আমাদের শেয়ার করে বাঁচতে হবে!
[এটি শেষ কিস্তি। সময় হচ্ছিলো না লেখার। একত্রিশ মে থেকে লকডাউন উঠে গেছে। ফ্যামিলি মেম্বারস, পরিচিত, বন্ধু বান্ধব, কলিগ, ফেসবুক ফ্রেন্ড, নাম ভুলে যাওয়া রোগী, সে, তারা- অনেকেই না জেনে এসেছেন লেখায়। কৃতজ্ঞতা সবার প্রতি। প্লাটফর্ম-কে ধন্যবাদ। তারা সম্ভবত পুরোটিই তাদের সাহিত্য পাতায় ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ করে গেছে। ভেবেছিলাম এটি এমন এক সময় শেষ হবে যখন পৃথিবীতে করোনা আতঙ্কও শেষ হবে। আতঙ্ককে মাঝপথে রেখেই লেখা শেষ হয়ে গেল।]