প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ১৯ মে ২০২০, মঙ্গলবার
ডা. শুভদীপ চন্দ
কোয়ারেন্টাইন শব্দের উৎপত্তি ল্যাটিন ভাষা থেকে। যার অর্থ চল্লিশ। ১৬০০ সালের দিকে ভেনিস শহর ও ইউরোপে এ প্র্যাক্টিসটি ছিল। যারা জাহাজে করে ফিরতেন এশিয়া, আফ্রিকা, আমেরিকা থেকে তাদের আলাদা করে রাখা হতো। যেন ইনফেকশাস ডিজিজ না ছড়ায়। কোয়ারেন্টাইন এখন চল্লিশের গণ্ডি ছোট করে চৌদ্দতে এসে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু আমাদের ধৈর্য তার চেয়েও কমে গেছে। আমরা মানি না প্রায় কিছুই। তাড়াহুড়ো চলে দুই পক্ষ থেকে।
নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কাকে দেখে কষ্ট হয়। লিও টলস্টয় লিখেছিলেন ‘দি স্ট্রংয়েস্ট অফ অল ওয়ারিয়র্স আর দিজ টু- টাইম এন্ড পেশেন্স’। আমরা দুই ওয়ারিয়র্সকেই হারিয়ে ফেলেছি।
যত সময় যাচ্ছে কিছু নির্মম সত্য তত দৃশ্যমান হচ্ছে। গতকাল এক কলিগের শ্বশুর করোনা নিয়ে আরো অসুস্থ হয়ে পড়লেন। স্যাচুরেশন ফল করা শুরু করলো। চেষ্টা করেও আইসিইউয়ে এক বেডের সন্ধান পেলাম না। সব বেড অকুপায়িড। অস্পষ্ট ধোঁয়াশা, অন্ধকার- প্রায় সর্বত্রই। কোথায় নক করতে হবে, কাকে নক করতে হবে- কেউ জানে না। এক দুই চ্যানেল যা আছে তাও লোকে অব্যবহৃত রাখতে চাচ্ছে। যদি ভবিষ্যতে নিজের প্রয়োজন হয় তখন যেন হাত পাতা যায়। এবং বেশিরভাগই নিশ্চিত না অপশন ক্লিক করবে কিনা। আসলেই একটি বিপদ উন্মোচন করে প্রাণীর আসল রঙ। ভেন্টিলেটর মেশিন কখনোই সমাধান নয়, তবে স্বান্তনা অবশ্যই। সেটুকুও হয়তো আমরা পাব না।
ইতোমধ্যে মানুষ লকডাউন থেকে মুক্ত হতে চাচ্ছে। গত দুইমাসে আমরা ছয়টি জিনিস শিখেছি। আমার অভিমত এ ছয়টি জিনিসকে গলায় তাবিজ বানিয়ে ঝুলিয়ে রাখতে হবে। প্রথমত করোনা ছড়ায় হাঁচি কাশির মাধ্যমে। মাস্ক, হাইজিন, সোশ্যাল ডিস্টেন্সিং তাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
দ্বিতীয়ত করোনা ছড়াচ্ছে কাছাকাছি ও দীর্ঘসময় কনটাক্টের কারনে। সেজন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ভীড় ও পাবলিক ট্রান্সপোর্ট। শর্ট ইন্টারেকশনে ঝুঁকি অনেক কম। তৃতীয়ত সিম্পটোম্যাটিক কেস ছড়ায় বেশি। সিম্পটম আসে সাধারণত প্রথম সপ্তাহে। উপসর্গ না থাকলে ভয় কম। চোখ কান খোলা রাখতে হবে। চতুর্থত শিশুরা কোভিডের জন্য আক্ষরিক অর্থেই দেবদূত। করোনা ছড়ায় বড়দের মধ্য দিয়ে। পঞ্চমত বয়স্ক মানুষ ও যাদের কো মরবিডিটি আছে তারাই বেশি ভুগছে। তাদের বাঁচাতে হবে।
ষষ্ঠত মৃত্যুহার ১% এর কম। SARS এবং MERS এর তুলনায় কম। তাই আশা হারানো চলবে না।
লকডাউন আক্রান্ত কমাবে। কার্ভ ফ্ল্যাট করবে। কিন্তু লকডাউন কোনো চিকিৎসা নয়। করোনার কোনো সুস্পষ্ট চিকিৎসা এখনো পাওয়া যায় নি। ভ্যাক্সিন এখনো বহুদূর।
আমি প্ল্যান করছি সামনের দিনগুলো নিয়ে। ছয় পয়েন্টের উপর ভিত্তি করে। ধারণা করছি ত্রিশে মে-র পর লকডাউন উঠে যাবে। গণপরিবহন চলবে। স্বাভাবিক ধারায় আবার ফিরতে হবে। আমাদের করোনাতে অভ্যস্ত হতেই হবে। করোনার সাথেই বসবাস করতে হবে। আর এর জন্য দরকার কাঁটছাঁট। সে নিয়েই ভাবছি।
আজ বাইরে তপ্ত রোদ। মোবাইলে তাপমাত্রা দেখাচ্ছে ৩৫ ডিগ্রি, ফিলস লাইক ৪৩ ডিগ্রি। জানালা দিয়ে যেন আগুনের হল্কা ঢুকছে। এরমধ্যে অনবরত ফ্ল্যাটের কাজ চলছে। টাইলস কাটার শব্দ, কাঠে পেরেক গাথার শব্দ, মেঝে পেটানোর শব্দ। শব্দেরও নিজস্ব উত্তাপ আছে।
কোনো নির্মান শ্রমিকের মুখে মাস্ক দেখি নি। এটা সম্ভব না সম্ভবত এ গরমে মাস্ক পরে কাজ করা। করোনার মৃত্যুর চেয়ে অনেক মৃত্যু অনেক বেশি কঠিন। সেগুলো অতৃপ্তির মৃত্যু। অক্সিজেনের অতৃপ্তি, খাবারের অতৃপ্তি, চিকিৎসা না পাওয়ার অতৃপ্তি।