প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২২ মে ২০২০, শুক্রবার
ডা. শুভদীপ চন্দ
সে রাতগুলোও এরকম ছিল। আজ থেকে দুইশো বছর আগে। প্রাকৃতিক দূর্যোগে বন্দী জীবন। রাতে কেঁপে কেঁপে উঠা মোমবাতির আলোয় ভূতের গল্প। এর মাঝেই ছোট দলটাতে স্থির হলো প্রত্যেকে একটি করে ভূতের গল্প লিখে জমা দিবেন। দলের সদস্য গ্রেট লর্ড বায়রন, বায়রনের প্রেমিকা ক্লেরি ক্লেরমন্ট, বায়রনের ব্যক্তিগত চিকিৎসক জন পলিডরি, বিখ্যাত কবি পি বি শেলী ও তার স্ত্রী মেরি শেলী। জন পলিডরি লিখলেন ‘ভ্যাম্পায়ার’, মেরি শেলী লিখলেন ‘দ্যা ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’। সময়টা ১৮১৬। স্থান জেনেভা। একসাথে জন্ম নিল কালজয়ী দুই কালচরিত্র- ফ্রাঙ্কেনস্টাইন ও ভ্যাম্পায়ার। লর্ড বায়রন সেদিন ফ্রাঙ্কেনস্টাইনকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছিলেন। মেরী শেলী তখন অষ্টাদশী।
ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের গল্প সবাই জানি। এক পাগল বিজ্ঞানী মৃতদেহ জুড়ে জুড়ে সেখানে বিদ্যুৎ প্রবাহ করে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে ফেললেন। কিন্তু তার সাথে তার সৃষ্টির বনিবনা হলো না। দানব ফ্রাঙ্কেনস্টাইন তার সৃষ্টিকর্তাকে হত্যা করে ফেললো….।
ফেসবুকে অনেক চ্যালেঞ্জ দেখে এ চ্যালেঞ্জের কথা মনে পড়ল। সত্যি এটি পারফেক্ট আবহাওয়া অপরাধ ও রহস্য সৃষ্টির জন্য। মুখোশে ঢাকা শহরে প্রমাণ সব ধোঁয়ায় হারিয়ে যাবে। সে সময়টা সবচেয়ে ভয়ংকর যখন কান্না শোনারও কেউ থাকে না।
কোভিড আইসিইউ-র বেড নিয়ে আজকেও এক রিকোয়েস্ট আসলো। আমি ভাবছি সে দিনের কথা। যখন এক বন্ধুর সাথে যাব খুব বড় মাপের কারো সাথে দেখা করতে। বন্ধু ব্যাখ্যা করতে থাকবে আমি তার কত ঘনিষ্ঠ, কত মেধাবী। তিনি আমার দিকে তাকাবেন, বিচার করবেন, আমার বিশেষত্ব যাচাই করবেন। তারপর বলবেন- ‘তোমার জন্য সুখবর আছে। পাঁচ নম্বর বেডের রোগীটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। মারা গেলেই তোমাকে দিতে পারব।’
একজন মারা গেলে অক্সিজেনের নলটা তার মুখ থেকে সরে আমার মুখে ঢুকবে। অথবা আমার কোনো আত্মীয়ের। সেও এক অপেক্ষা। সেও এক প্রার্থনা। করোনা আমাদের জন্য বড় পরীক্ষা। শুধু মানবতার নয়, নিজের সাথে নিজেরও পরীক্ষা।
এখন অনেক মেসেজ আসে- অনলাইন শপিং বা ডাইনিং। সেহরি ইফতারির। একদম ঘর পর্যন্ত পৌছে দিবে, সাথে ছাড়ের অফার। এখন ভাবি এসব ছাড়াও জীবন চলে। গাছ চিনে, বাজারে গিয়ে মাছ চিনে, দুই এক ফুল টবে লাগিয়ে, বা সিনেমা দেখেও জীবন যায়। পাখির ডাক শুনেও জীবন যায়। আজ রাজেশ্বরীর সইয়ের নাম জানলাম। ও পিচ্চি ডাকছিলো- ‘রা-জে-শ্ব-রী… ও রা-জে-শ্ব-রী..’। আমি বললাম ‘তোমার নাম কি?’ বললো ’দোলা’। আবার বললাম ‘কি…?’ বললো ‘দো-লা–‘। একটু একটু করে লক ডাউনের সাথে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি। আমরা ফ্রাঙ্কেনস্টাইন বানিয়ে ফেলেছিলাম। এখন ফ্রাঙ্কেনস্টাইন আমাদের হত্যা করতে চলেছে।
সে ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের গল্প কিন্তু সেখানেই শেষ নয়। ঈশ্বরকে অমান্য করে ফ্রাঙ্কেনস্টাইন তৈরির অভিশাপ বয়ে বেড়িয়েছিলেন তারা প্রত্যেকেই। কবি দার্শনিক লর্ড বায়রন মারা গেলেন ৩৬ বছর বয়সে। গ্রীসকে স্বাধীন করতে গিয়ে, রোগে ভূগে। ইংলিশ সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ রোমান্টিক কবি পি বি শেলী মারা গেলেন ২৯ বছর বয়সে- নৌকা ডুবিতে। জন পলিডরি মাত্র ২৬ বছর বয়সেই আত্মহত্যা করলেন। মেরী শেলী বেঁচে থাকলেন এক বুক নিঃসঙ্গতা নিয়ে। যার জীবনে শুধু ট্র্যাজিডি। অকাল মৃত্যু দেখেছেন পরপর তিন সন্তানের, স্বামীর। বোনের আত্মহত্যা দেখেছেন। বাবার বিরাগভাজন হয়েছেন। শেলীর প্রথম স্ত্রীর আত্মহত্যার সাক্ষী হয়েছেন। জীবন তাকে কখনোই ক্ষমা করে নি। পরে মারা যান ৫২ বছর বয়সে।
গত দুইদিনের আবহাওয়া কেমন জানি সে সময়ের মতো। ঝড়, বৃষ্টি, অন্ধকার, নিস্তব্ধ, আর অভিশপ্ত!