১৪ এপ্রিল ২০২০:
ডা. শুভদীপ চন্দ
মহান শেক্সপিয়ার একবার বলেছিলেন “One touch of nature makes the whole world kin”। ‘প্রকৃতির এক ধাক্কাই যথেষ্ট সবার ফুটানি ছুটিয়ে দিতে’! এ কোভিড ১৯ আসার আগে কী কেউ ভেবেছিলো- প্রধানমন্ত্রীকে ঘরে বসে থাকতে হবে, রাজা বাদশাদের কোয়ারেন্টাইনে যেতে হবে, জেল খুলে কয়েদীদের মুক্ত করে দিতে হবে, গরিবের স্বাস্থ্য নিয়ে বড়লোকদের ভাবতে হবে! এখন হচ্ছে।
আজ সকাল ছিল ঝরঝরে। ঝড়ের রাত্রির পরের ভোর সবচেয়ে সুন্দর। কেমন এক আম বোলের গন্ধ পাওয়া যায়। ঝরা পাতায় রাস্তাঘাট ভরে থাকে। ভেজা বিল্ডিং, সবুজ গাছ গাছালি, ভোরের সূর্য, ঠান্ডা বাতাস- অপূর্ব। এ লকডাউনের সময়েও ঝড়, বৃষ্টি, রোদ, বাতাস- কোনোকিছুর কমতি নেই। প্রকৃতি তার নিজস্ব প্ল্যানে চলছে। লকডাউন, জীবন, মৃত্যু- এসব নিয়ে সে খুব বেশি চিন্তিত নয়।
আজ সকালে রাস্তায় অনেক লোক ছিল। রিকশা, অটোরিকশা, ব্যাটারি গাড়ি অন্যদিনের তুলনায় বেশি ছিল। পুলিশ আমার চলতিপথে দেখি নি। অনেক দোকান খোলা। বিভিন্ন স্থানে দেয়া বাঁশ ও দড়ির ব্যারিকেড খুলে ফেলা হয়েছে। কিন্তু দুপুরে ‘করোনাভাইরাস আপডেট’ ঘোষণার পর পরিস্থিতি পাল্টে যেতে থাকে। পুলিশ সদস্যরা রাস্তায় নামেন। দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। এখানে বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত বাজার ও মুদি দোকান খোলার অনুমতি আছে। ছটার পর কার্ফু জারি হয়। বাসার বাইরে কেউ থাকেন না। ঔষধের দোকানও বন্ধ থাকে।
উনিশটি জেলা লকডাউনে। দেশে করোনাভাইরাস ছড়ানোর ক্লাস্টার পর্যায় চলছে। ক’দিন পর কমিউনিটি পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়বে। নারায়ণগঞ্জে এক ক্লাস্টার ছিল। সেখান থেকে লোকজন যে যেভাবে পারে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। নদীপথে যাচ্ছে, এম্বুলেন্স করে যাচ্ছে। তাদের ধরিয়ে দিচ্ছেন প্রতিবেশীরা। জেলা উপজেলা পর্যায়ে হাসপাতাল রেডি করা হচ্ছে। বেড আইসোলেট করা হচ্ছে। পাঁচ ছয়টি অক্সিজেন সিলিন্ডার, নেবুলাইজেশন মেশিন রেডি রাখতে বলা হয়েছে। আমাদের উপজেলায় দুইটি প্রাইভেট ক্লিনিক করোনার জন্য প্রস্তুত করতে বলা হয়েছিল। ক্লিনিক মালিকরা দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন তাদের ক্লিনিক না দেয়ার জন্য। বাড়ি থেকে সাসপেক্টেড রোগীর স্যাম্পল কালেকশনের জন্য গাড়ি ঠিক করা হয়েছিল। ড্রাইভাররা এ কাজ করতে চান না। সবাই সংক্রমণের ভয়ে আছেন। আজ এক ড্রাইভার ফোনে বলেছেন তিনি দরকার হলে না খেয়ে থাকবেন, তবুও এ কাজ করবেন না।
হাসপাতালে আজ এক করোনা সাসপেক্টেড রোগী ভর্তি করেছি। সিস্টার, ব্রাদার, ওয়ার্ডবয়, স্যুইপার- কোথায় পালাবে বুঝে পাচ্ছিলো না। বাধ্যহয়ে আমিই ঔষধ বুঝিয়ে দিয়েছি, অক্সিজেন মাস্ক লাগিয়ে দিছি। অন্য এক ডাক্তার টাকা দিয়েছেন ঔষধ আনার জন্য। কারন রোগীর সাথে কেউ আসে নি, তার টাকা কেউ স্পর্শ করবে না!
আমাদের কোনো কমপ্লেন নেই কারন সবাই শেষপর্যন্ত এসেছেন। তার কাজটুকু করেছেন। এটি অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। এখানে নিজেকে তার অবস্থানে চিন্তা না করে জাজ করা অন্যায় হবে।
ইউনিয়ন লেভেলে প্রাইমারি স্কুল গুলোকে সম্ভবত রেডি করা হবে। এখন অগুনিত টেস্ট করা যাচ্ছে। সকালে সব স্যাম্পল নিয়ে জেলা শহরে চলে আসে সবগুলো থানার এম্বুলেন্স। WHO র এক গাড়ি করে ছয় জেলার স্যাম্পল একসাথে ঢাকায় চলে যায়। সবার মোবাইল নাম্বার রাখা হয়। সমস্যা হচ্ছে এখন রোগীরা টেস্ট করতে চান না। টেস্ট করার কথা বলা হলে পালিয়ে যান। সবচেয়ে দুঃখ লাগলো শুনে গোরখুড়ে দের অনলাইন প্রশিক্ষণ হচ্ছে। এ যুদ্ধে আমরা সবাই ঘরে ফিরব না! দূর থেকেই বিদায় দিতে হবে অনেককে।
ভারতে আক্রান্ত বাড়ছেই। সাড়ে আট হাজার আক্রান্তের মধ্যে ৯০ জন মেডিকেল স্টাফ। আমেরিকান মৃত্যু ২০,০০০ ছাড়িয়েছে। নিউইয়র্কে এখন প্রতিদিনই নাইন ইলেভেনের শোক। ইতালি ও স্পেনেও মৃত্যু বিশ হাজার ছাড়াবে। রবিবার স্পেনে মৃত্যু আবার ছয়শো ছাড়িয়েছে। বিবিসি বলছে ইউরোপের সবচেয়ে দুর্ভাগা দেশটি হবে ব্রিটেন। বরিস জনসন হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন।
এদিকে কচুরিপানায় ফুল এসেছে। বেগুনি রঙা ফুল সম্পূর্ণ ডোবা ধরে ফুটে। রাস্তার দুপাশে দিগন্ত বিস্তৃত ধান ক্ষেত, তার আগে একটু ডোবায় বেগুনি বেগুনি ফুল। এ ফুলের গন্ধ আছে কিনা জানি না। সবুজ কচুরিপানা এতো বেগুনি রঙ কিভাবে ধরে- সেও বুঝি না!