প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ৬ জুন ২০২০, শনিবার
ডা. শুভদীপ চন্দ
কবি নির্মলেন্দু গুণের বিয়ে হয়েছিল মেডিকেল ছাত্রী নীরা লাহিড়ীর সাথে। তাদের কন্যা মৃত্তিকা। মৃত্তিকা জন্মের পর তাকে লালন পালন করার জন্য গ্রাম থেকে গীতা নামে এক কেয়ারটেকার নিয়ে এসেছিলেন। একসময় নীরার সাথে গুণের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। নীরা মেয়েকে নিয়ে আলাদা হয়ে পড়েন। গুণ গীতা ও গীতার জ্ঞাতিগুষ্টি সহ বস্তিতে গিয়ে উঠেন। বস্তিতেই থাকতেন। তাদের ভরনপোষণও তিনি দিতেন। গীতা তখন একটি স্কুলে ঘন্টি বাজানোর কাজ নেন। আর পড়াশোনা করাতে থাকেন ছোট বোনদের। কবি তার কাব্যসমগ্রের প্রথম পর্ব উৎসর্গ করেছেন কবি শামসুর রাহমানকে। দ্বিতীয় পর্ব গীতাকে। গীতা গাণ্ডীবা দাসীকে!
তিনি বস্তিতেই থাকতেন। বস্তির খাবার খেতেন, বস্তির ভাষায় গাল পারতেন। সামর্থ্য থাকলেও ভদ্র বাসায় উঠেন নি কারন বস্তিপনা ভাল মধ্যবিত্ত প্রতিবেশীদের সহ্য হবে না। জুয়া খেলতেন আর হারতেন। ‘কেন খেলেন’- জিজ্ঞাসা করা হলে বলেন ‘না খেললে বন্ধুরা হারামজাদা বলে গাল দেয়…’। হারতে তার আপত্তি নেই, কিন্তু বন্ধুর মুখে গালি শুনতে তাঁর অরুচি।
রেসিজম- এক মানুষ অন্য মানুষকে ঘৃণা করে গায়ের রঙের জন্য, ধর্মের জন্য, শ্রেণী বৈষম্যের জন্য। আমরা আমেরিকার রেসিজমের সমালোচনা করি। কিন্তু আমরা কী পারব বাসার হেল্পিং হ্যান্ডকে নিয়ে এক টেবিলে বসে খেতে? হাসপাতালে গিয়েও মানুষজন গৃহকর্মীকে আলাদা করে রাখে! কবি নির্মলেন্দু গুণ এতো বছর আগে নির্মোহ ঋষিসুলভ ভঙ্গিতে যা করে গেছেন- আমরা কী পারব?
উনি আমার ফ্রেন্ডলিস্টে আছেন। উনার মেয়ে মৃত্তিকা গুণ একটি নাটক পরিচালনা করেছেন। উনি প্রচারণা চালান। ভাল লাগে দেখতে। পরিবারের একটি হাস্যোজ্জ্বল ছবির চেয়ে ভাল উত্তর ‘হোয়াটস অন ইয়োর মাইন্ড’-এ আর কী হতে পারে!
একটি শিশু জন্মের পরই প্রথম কাঁদে। প্রথম কখন হাসে- বলতে পারেন? তৃতীয় বা চতুর্থ মাসে। যখন সে তার বাবা-মাকে প্রথম চিনে। তার হাসি তার ফেস আলাদা করতে পারার মাইলফলক। তার আগে গার্গল বার্বল করতে পারে, কিন্তু হাসবে না। তারপর একসময় খলখলিয়ে হাসে। যখন সে প্রথম ডাবল সিগন্যাল পায়। তার মা বলে ‘দেখো তোমাকে বিপদে ফেলে দিচ্ছি, কিন্তু ভয় পাওয়ার কিছু নেই কারন বিপদটা আমার তরফ থেকে আসছে’। সে হতে পারে শূন্যে ছুড়ে দেয়া, হঠাৎ ছেড়ে দিয়ে ধরে ফেলা, বা আলতো চাপ দেয়া। শিশু বুঝে এটি বিপদ না, খেলা। সে হেসেই কূল পায় না!
পরিবার তাই সবার আগে। যারা কিছুই লিখে না ফ্যামিলি ছবি দেয়, অদ্ভুত লাগে। আমার সিনিয়র আপু, জুনিয়র, ব্যাচমেট, বোনেরা। আমার তো বলার মতো কোনো গল্প নেই, তাই তাদেরকেই ফলো করি। কোভিড উনিশ প্রমাণ করে দিলো- কোনোকিছুই একটি ঘরের চেয়ে বড় না। আগে ঘর। ঈশ্বর কান্না শিখিয়ে পাঠাতে পারেন, হাসিটা কিন্তু ঘর থেকেই শিখতে হয়।
যিনি আড়াইটার দিকে খবর পড়েন, তিনি আজকের খবর পড়েন না। কবের খবর পড়েন- তা শুরু করার আগে তিনিও জানেন না আমরাও জানি না! আজ আমার হেলথ কমপ্লেক্সে একজন ডাক্তারসহ কিছু স্টাফ পজিটিভ হয়ে গেলেন। আমার আক্রান্ত হওয়া এখন সময়ের অপেক্ষা মাত্র। এ রিপোর্ট পাঁচ ছয়দিনের পুরনো। আক্রান্তদের সাথে ফোনে কথা বলি। সাহস দেই। সবাই তার পরিবার নিয়ে চিন্তিত। বাবা মাকে নিয়ে চিন্তিত।
কত ডাক্তার যে আলাদা থাকছেন- চিন্তাই করা যায় না। আক্রান্ত হবো, পরিবারের অন্য সদস্যদের আক্রান্ত করবো- এ ভয়ে একা একা থাকছেন ভাবাই যায় না। অনেকে পজিটিভ নিয়েও চুপচাপ বসে আছেন। বাড়িতে জানালে অহেতুক দুশ্চিন্তা করবে বলে জানাচ্ছেন না। বলে- ‘মরে গেলেই এমনিই জানবে…’। সবচেয়ে খারাপ সময় আমাদের সবচেয়ে ভাল ফর্মকে বের করে আনছে।
দেখি আর অবাক হই।