প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ১৩ জুন ২০২০, শনিবার
ডা. শুভদীপ চন্দ
প্রতিদিন ভোর হয় একগাদা দুঃসংবাদ দিয়ে। সংবাদপত্রের সাথে যোগ হয়েছে ফেসবুকের ব্যক্তি কথা। ছবি ও খবরে প্রকাশ পাচ্ছে আমরা হেরে যাচ্ছি; খুব দ্রুত গতিতে।
প্রতিদিন কেস বাড়ছে মৃত্যু বাড়ছে। মানুষের সাফারিঙ আকাশ ছুঁয়েছে। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার আগেই রোগী মারা যাচ্ছেন। মেয়ে যে হাসপাতালের ডাক্তার সেখানে পর্যন্ত তার বাবাকে ভর্তি করাতে পারছে না। আইসিইউ খুঁজতে খুঁজতে এক গর্ভবতী মা মারা গেলেন। কোভিড আন-ডকুমেন্টেড মৃত্যু যে কত তার ইয়ত্তা নেই। টেস্টের ঝামেলা মিটছে না, বরং বাড়ছে। বাড়ছে অসহিষ্ণুতা, দায়িত্বশীলদের আবোলতাবোল কথা। অন্য রোগের প্রকোপেও মানুষ মারা যাচ্ছে। ডায়েবেটিস, হার্টের রোগী, কিডনি রোগী- ক্রিনিক ডিজিজের ফলো আপ শিডিউল পেছাচ্ছে তো পেছাচ্ছেই।
সম্ভবত জোনাকির মতো জ্বলে নিভে জ্বলে নিভে মরার চেয়ে এক আগুনেই পুড়ে মরা ভাল। মনের ভিতর সারাদিন যে ঝড় চলে যেকোনো মৃত্যু সংবাদেই তা রুদ্ররূপ পায়। পড়েছিলাম- চিড়িয়াখানার জন্তুরা বিরক্তিকর একঘেয়েমি কাটানোর জন্য রিদমিক স্টেরেওটাইপড কাজ করতে থাকে। খাঁচার মধ্যে এ মাথা থেকে ও মাথা হাঁটে, শিম্পাঞ্জিরা কান খোঁচায়, হাতি মাথা নাড়ে, কেউ কেউ নিজেকে কামড়ায়। চিড়িয়াখানা আমাদের শহরের আদলে তৈরি। আমরাও বন্দী দুর্ভাগ্য আর একঘেয়েমি দিয়ে। সারাদিন একই কাজ করি রিদমিক ওয়েতে। দুইশো বার মোবাইল হাতে নিই দুইশোবার লগইন লগ-আউট করি। সিনেমা দেখা শুরু করি শেষ করি না। চ্যাটে কেউ নক করলে একি কথা একই ভাবে বলি। ‘ভাল থাকবেন’ ‘সাবধানে থাকবেন’ ‘ভাল আছি’। কখনো কখনো টের পাই হাতের তালু ঘামছে। রুমাল ভিজে জবজবে হয়ে যাচ্ছে। স্ট্রেস।
‘ওয়েটিং ফর দ্যা ট্রেন টু গো অর দ্যা বাস টু কাম, ওর দ্যা প্লেন টু গো অর দ্যা মেইল টু কাম। ওয়েটিং ফর দ্যা ফোন টু রিং, অর ফর দ্যা ডে উই বিকাম কিং…।’
মাঝেমাঝে পুরনো কথা ভাবি। নিজেকে বিচারকের আসনে বসিয়ে। আমাদের প্রেম কী ‘প্রেম’ ছিল, না শুধু প্রেমের প্রতি প্রেম ছিল? আমরা আচরণ করে গেছি অন্যরা যেমন করতো। আমাদের উপন্যাস কবিতা সিনেমায় যেভাবে লেখা থাকে। নিঃসঙ্গতা- একাকীত্ব- আকর্ষণ- প্রেম করার আগ্রহ- প্রেম। আমরা রোমান্টিক নই কারন ভীরু। ভীরুতা নিয়ে প্রেম হয় না। আমাদের সাহসই নেই কিছু চাইবার। কোমড় সোজা করে দাঁড়াবার। অনাদৃতের প্রতি যেমন কারো কারো করুণা হয়, আমাদের প্রেম ছিল সে অনাদৃতের প্রেম। যে উত্তরাধিকার সূত্রে রাজা হয়ে জন্মায় আর যে কর্ণের মতো বন্ধুর অনুগ্রহে রাজত্ব পায়- পার্থক্য থাকবেই। কর্ণের বীরত্ব থাকার পরেও এক জন্ম যায় দাক্ষিণ্যের প্রতি তোষামোদ করতে করতে। আমরা এখনও তা করি। ছুঁড়ে দেবার পরিবর্তে ঘরের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ দেয়ালটায় বাঁধিয়ে রাখি! আমরা সবচেয়ে দুর্ভাগা প্রজন্ম। সংস্কার ও আধুনিকতার মাঝে স্যান্ডউইচ।
কোভিড উনিশ এক সুযোগ করে দিয়েছে। মৃত্যুর রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলা লোকগুলোর জবানবন্দি দেয়ার। ফরেন্সিক মেডিসিন মতে ডায়িং ডিক্লেয়ারেশন কখনো মিথ্যে হয় না। আবার ইভিডেন্স হিসেবে খুব বেশি পোক্তও হয় না। সে সুযোগই নিচ্ছি!
এদিকে দূরে পশ্চিমে যখন সন্ধ্যা নামে- আকাশ যেন লালের পশরা সাজিয়ে বসে। মেঘগুলোয় লেগে থাকে লাল আবিরের রঙ। কাছেই এক মসজিদ থেকে আযান শোনা যায়, বড় মায়াবী কন্ঠ। আযানের পর আসে পাশের বাড়ির উলুধ্বনি, শঙ্খ ধ্বনি। রাতের দেবদেবীকে বরণ করে নিচ্ছেন। ঘন্টার শব্দ- অশুভ শক্তিকে তাড়িয়ে দিচ্ছেন। খবর পাই আমার এক বন্ধুর বাবা মারা গেছেন। বন্ধুটির জন্য খারাপ লাগে। তাকে ফোন দিব, ঢেল ছোঁড়া দূরত্বে তার বাসায় যাব, ঘাড়ে হাত রেখে কথা বলবো- ভাবি কী বলবো! কী সান্ত্বনা দিবো! বিরক্ত লাগে নিজের উপর সবকিছুর উপর। প্রতিদিনই মৃত্যু সংবাদ পাচ্ছি বিভিন্ন ফ্রন্টে। আমরা আমাদের আগের প্রজন্মকে হারিয়ে ফেলছি। নীরবে।
আর শোনা হবে না পুরনো গল্পগুলো- যেগুলো শুনে শুনে আমরা বড় হয়েছি।