প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২৪ জুন ২০২০, বুধবার
ডা. শুভদীপ চন্দ
আমার মাকে দেখি আমাদের সবার উপর বিরক্ত হলে চুপচাপ রান্না করেন। এ রান্নাঘর জিনিসটা অদ্ভুত। আজেবাজে গরু ছাগলের খাওয়া ঢুকে, সুস্বাদু মশলাদার খাবার হয়ে বের হয়। তবে আমার ধারনা তিনি এরকম করেন কারন তিনি এ কাজে মগ্ন থাকতে পারেন। তার সময় থমকে থাকে। আর অদৃশ্য কাঁটাতারের বেড়া আমাদের থেকে তাকে দূরে রাখে। আমরা সহজে রান্নাঘরে ঢুকি না। যখন দেখি আমরা অনেকক্ষণ কেউ বকা খাচ্ছি না তখন বুঝি সামথিং ইজ সিরিয়াস রঙ!
আমরা ভাইবোন একদিকে এগুই নি। তাই আলাদা আলাদা জব, আলাদা আলাদা জীবন। তবে আমাদের সবার ছুটি আছে- সপ্তাহে, মাসে, বৎসরে। রান্নাঘরের কোনো ছুটি নেই। ধর্মীয় দিন হোক বা ভোটের দিন। শিডিউলে কোনো ব্যত্যয় নেই। কোথাও যাওয়ার দিন, কোথাও থেকে ঘুরে আসার দিন- ছোট করে হলেও রান্নাঘর খোলা রাখতে হয়। কোভিড উনিশ সারা পৃথিবীকে রাস্তা থেকে রান্নাঘরে পাঠিয়েছে। শ্রেষ্ঠ তো সেইই- যার কাছে শেষ আশ্রয়।
একজন উপজেলা হেলথ অফিসারকে চিনি; ভদ্রলোক চেয়ারে বসেই কাজ শুরু করেছিলেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। রোগীদের দেখভাল- খাবার দাবার- নিয়মনীতি নিয়ে ভাবছিলেন। আজ দেখলাম তার বিপক্ষে বড় করে নিউজ হয়েছে। গ্রাম্যজীবন, গ্রাম্য মনমানসিকতা, গ্রাম্য রাজনীতি- সরল, যৌগিক, জটিল বাক্যের উদাহরণ। পত্রিকার মতো মারাত্মক অস্ত্র আর নেই। একফোঁটা রক্ত বের না করে হাজার হাজার চোখের সামনে যে কাউকে খুন করে ফেলতে জানে!
দিন যাচ্ছে তার মতো করে। কামাল লোহানী মারা গেলেন, মাশরাফির করোনা পজিটিভ আসলো, প্রতিদিনকার গ্রাফে আরো কিছু নড়চড় হলো। আতঙ্ক বাড়তে বাড়তে ফেটে গিয়েছে। টের পাই- মানুষ এখন আতঙ্ক নিয়ে আতঙ্কিত নয়। আকাশে ঘুড়ি উড়ায়। বাহারি রঙে বাহারি ঘুড়ি। চীল, সাপ, ড্রাগন, ভূত- ভারী ভাল লাগে দেখতে। ‘ঘুড়ি খেলার নিয়ম সিম্পল- অন্যেরটা কাটো নিজেরটা উড়াও…’।
এদিকে ভারত চীন সীমান্ত উত্তপ্ত। আমরা সম্ভবত বেশিরভাগ চীনপন্থী। বন্ধু শত্রু বদলানো যায়, প্রতিবেশী বদলানো যায় না। যুদ্ধে কি হয়? একদিন যুদ্ধ থামে। নেতারা হাত মেলায়, ছবি তুলে। দুই বৃদ্ধ অপেক্ষা করতে করতে মারা যায়। এক বৌ বাকি জীবন ছবির সাথে ঘর করে। কিছু ছেলেমেয়ে পুরনো কোট-বেল্ট-টুপি-ইউনিফর্ম ছুঁয়ে ছুঁয়ে বড় হয়। নিহত কারো নাম কোথাও থাকে না, থাকে রাজা বাদশাহদের নাম। পতাকার রঙ দিয়ে কী হবে- মানুষ ভাল থাকুক।
কাল থেকে ডিউটি শুরু হচ্ছে। করোনার সাথে আবার লুকোচুরি খেলতে হবে। এ ডিউটি শুরুর দিকে ভয় থাকে, শেষদিকে আনন্দ। এ চক্রাকার যতদিন চলবে ভয় আর আনন্দ একে অপরকে ফলো করবে। এ যুদ্ধে সেই স্মার্টেস্ট যে সবার শেষে আক্রান্ত হবে। আমরা করোনা নিয়ে পিলো (pillow) গেম খেলছি। বানাচ্ছি সবচেয়ে বড় হিউম্যান চেন। কালো সাদা চাইনিজ ভারতীয়- কোনো সীমানা নেই।
সুশান্ত সিং রাজপুতের মৃত্যু নিয়ে দেয়া স্ট্যাটাস আরো দশটি স্ট্যাটাসের মতো। আমি ভাল আছি, ডিপ্রেশনে নেই। অত হৃদয় দিয়ে ভাবতে পারি না। ডিপ্রেশনে যেতে একটি শক্তিশালী হৃদয় থাকতে হয়। অনেকে খোঁজ নিয়েছেন। ধন্যবাদ। এক ফ্রেন্ড তার আঁকা ছবি গিফট করেছে। ছবির নাম ‘এ ওয়াক ইন দ্যা রেন’। ছবিটা মাথার পিছনের দিকে দেয়ালে টাঙাবো। যেন প্রতিদিন পড়তে বসার আগে ছবিটা দেখে বসতে পারি। আর যেন শিখতে পারি- একসাথে সারাজীবন থাকলেও একজনের সবকিছু আবিষ্কার হয় না। মানুষ সমুদ্রের চেয়েও বেশি গভীর!