প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২৪ জুন ২০২০, বুধবার
ডা. শুভদীপ চন্দ
তিনটি খবর, তিনটি উৎস, তিন রকম চিন্তা। প্রথমটির উৎস ফেসবুক। করোনা পজিটিভ রোগী রাত আড়াইটায় পালিয়ে গেছেন, ডিউটি ডাক্তারকে শোকজ করা হয়েছে। রোগী পালিয়েছে কারন রোগী আলাদা কিছু দেখছে না। এর চেয়ে বাসায় চিকিৎসা নেয়া উত্তম মনে করেছে।
কোভিড একটি বাজে রোগ। এর কোনো চিকিৎসা নেই, ডায়াগনোসিসেও কোনো বাহাদুরি নেই। ক্লিনিক্যাল আই থাকলে যা না থাকলেও তা। রুটিন ফলোআপে নূতনত্ব কিছু নেই। সাথে মারাত্মক সংক্রামক। ডাক্তার সিস্টাররা স্বাভাবিক ভাবেই অহেতুক কাছে ঘেঁষতে ভয় পান। আর ঘেঁষে থাকবেনই বা কী করে? সম্পদের অপ্রতুলতা, মানের প্রশ্ন- নিশ্চয়ই ওখানে আছে। আমরা ডিউটি করি মাস্ক গ্লাভস নিজের পয়সায় কিনে। নিজের টাকায় কেনা গ্লাভস প্রত্যেক রোগীর জন্য বদলাবো না। আবার ইমার্জেন্সিতে এতো রোগী আসছে সবার জন্য আলাদা আলাদা গ্লাভস সাপ্লাই দেওয়াও সম্ভব না। যেখানে একটিই পাচ্ছি না। প্রতি রোগীতে অবশ্যই গ্লাভস বদলানো উচিত। গরিবের এত উচিত অনুচিত দেখলে চলে না।
এ মুহূর্তে রোগীদের হাসপাতালে আবদ্ধ রাখা জরুরি। কারণ রোগী একা পালাচ্ছেন না, রোগ সহ পালাচ্ছেন। কিন্তু বাবা মা গরিব- বুঝি। নিরাপত্তা কর্মী, গার্ড, ওয়ার্ড বয় রাখার টাকা নেই। তাই ডাক্তারদের কাছেই আশা করছে প্রহরীর দায়িত্ব। উদ্দেশ্য ভাল নিঃসন্দেহে। জনবান্ধব। ডাক্তাররা রোস্টার করে স্যুইপার ঝাড়ুদার পাহারাদারের কাজ করতেই পারেন!
দ্বিতীয় খবরটি দিয়ে গেল এক স্টাফ। আমাদের হাসপাতালে করোনা পরীক্ষা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। যেন আর এডভাইস না করি। বললাম কেন। বললো- রিপোর্ট আসতে দেরী হচ্ছে। আট দশদিন পেন্ডিং হয়ে গেছে। সেজন্য আপাতত এ আদেশ। আপাতত বলতে কতদিন- জানে না। নিশ্চয়ই ঢাকায় পারছে না চাপ সামলাতে! আগে প্রতিদিন হতো, এখন সপ্তাহে তিনদিন সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারিত। তাও বন্ধ হলো।
রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা মৃত্যুযন্ত্রণার সমতুল্য। অনেকে এ ভয়েই টেস্ট করাতে চান না। রিপোর্ট কবে আসবে- তার চেয়ে পজিটিভ নেগেটিভ কিছু একটা ধরে বসে থাকা ভাল। স্বাধীনতা নিয়ে থাকা যায়। যদি নিজেই না বাঁচি বাকি পৃথিবী নিয়ে চিন্তা করে কী হবে! কন্টাক্ট ট্রেস করে টেস্ট করা এ যুদ্ধের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য তরিকা। সবাই জানে। কিন্তু সাথে এও জানে আমরা গরিব। এতো পরীক্ষা নিরীক্ষার টাকা কই? ল্যাবই কই? তার চেয়ে জীবন সস্তা!
তৃতীয় খবরটি পেলাম পত্রিকা থেকে। প্রথম আলোয় লিখেছে এক আদম ব্যবসায়ী কিভাবে আইন প্রণেতা হয়ে উঠলেন। কোটি কোটি টাকার কানেকশন, সবাই ভাগ পেয়েছে। এজন্য কেউ কিচ্ছু জানতো না। বিদেশে গিয়ে ধরা খেয়েছেন। এখন বিস্তারিত চর্চা হচ্ছে। সেও সম্ভবত আইসবার্গের উপরের অংশ। লেনদেনের আসল আকৃতি কখনো জানা হবে না।
ঘেন্না লাগে পত্রিকা পড়তে। আমরা গরিব; সামর্থ্য নেই টেস্ট করার- সুরক্ষা দেয়ার- গার্ড রাখার, খারাপ লাগে নি। কিন্তু যখন দুর্নীতির খবর পড়ি যারা আমাদের চরিত্রের সার্টিফিকেট দেন- ঘেন্না লাগে। ডাক্তার দশ টাকার গ্লাভস পায় না, গর্ভবতী মা কে ডিজইনফেক্টেন্ট না করেই বেডে শুয়ে দেয়, অভাবে ঘোষণা দিয়ে পরীক্ষা বন্ধ রাখে; আর তারা ফুর্তির টাকা উড়ায় দেশেবিদেশে। তাদের হাতে আমার ভবিষ্যত। ভিতর থেকে দলা দলা থুথু বের হয়ে আসতে চায়। ভয়ে বমি হতে চায়।
চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করে- আমি কেন দুর্নীতি করবো না? সুযোগ পেলে সুযোগের সদ্ব্যবহার কেন করবো না? কারো বাঁচা-মরায় আমার কী? আমি কি পাবো? আমার পরিবার কী পাবে?
২৪/০৬/২০২০
…
আসলে করোনা আমাদের জন্য আশীর্বাদ ছিল। আমরা যে সিস্টেমে পড়ে মারা যাচ্ছিলাম- সেই তো জানতাম না। করোনা কোনো সিস্টেম ভাঙ্গে নি, ভাঙ্গা সিস্টেম উন্মোচন করে দিয়েছে। আমাদের ডেথ সার্টিফিকেটে মৃত্যুর কারণ করোনা, হার্ট এটাক, স্ট্রোক লেখা থাকবে কিন্তু আমরা এখন জানি আমাদের মৃত্যুর কারন ‘সিস্টেম’। মরার আগে এ জ্ঞানটি জরুরি ছিল।
.
‘ডে সেভেনটি নাইন’