প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২৬ জুন ২০২০, শুক্রবার
ডা. শুভদীপ চন্দ
ভিক্ষুকরা ভিক্ষা করার পাশাপাশি আরেকটি কাজ করে- প্রার্থনা। আমার সামনে যে ভিক্ষুকটি ভিক্ষা করছে ঈশ্বরের নাম নিচ্ছে অস্পষ্টভাবে। শুরুটা স্পষ্ট, শেষটা হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে। যেন সুরে সুরে বাকিটা বুঝে নেওয়া ঈশ্বরের দায়িত্ব। সবার ধারণা ঈশ্বরের তাদের প্রতি স্পেশাল এটেনশন থাকে। যদিও এর কোনো প্রমাণ নেই। ভিক্ষুকরা রাস্তাঘাটে জীবনযাপনে আর সবকিছুতে নরাধম, শুধু এক ক্ষেত্রে শাহেনশাহ- বেঁচে থাকার ক্ষেত্রে।
কার কত বেঁচে থাকা উচিত, কার কত আয়ু হওয়া উচিত- কে ঠিক করবে? তার অসমাপ্ত কাজ? ভিক্ষুকদের কোনো অসমাপ্ত কাজ নেই। কেউ তাদের জন্য পথ চেয়ে বসে নেই। তাদের দেখে মনে হয় তারা পৃথিবীতে অবাঞ্চিত হয়ে বেঁচে আছে।
সে শুধু তার অর্ধেক শরীর বের করে বসেছিল। তার ঘাটতি তার জন্য স্পিকার। নতুন কিছু বলার নেই। যারা ভিক্ষা দিচ্ছেন নীরবে দিচ্ছেন। সাধারণ আই কনটাক্ট না করেই। দুর্ভাগ্য সংক্রামক- এ সবাই জানে। আই কনটাক্টেও দুর্ভাগ্য চলে আসতে পারে এ ভয় সবার! এমনকি তারও। তাই সেও যথা সম্ভব সবকিছু এড়িয়ে বসে আছে। একজন ভিক্ষুকের কাছে সবচেয়ে মধুর শব্দ থালায় পড়া পয়সার শব্দ। এমনকি টাকারও এক শব্দ আছে। সে টের পায়।
রোগী আসে। স্ট্রোক কিনা জানার জন্য বলি- ‘হাত মুঠি করেন, খোলেন। আমার দুই আঙ্গুল শক্ত করে ধরেন।’ না পারলে উইকনেস, প্যারালাইজড। সামর্থ্য সবসময় এ ধরা ও ছাড়ার মধ্য দিয়ে। না পারলে সামথিং ইউ নিড টু বি ওরিড। সংকোচন ও প্রসারণে বন্দী পুরো পৃথিবী। ডাক্তার মৃতের চোখে আলো দিয়ে এ সংকোচন প্রসারণই খোঁজেন। সাইকোলজিস্ট মৃত সম্পর্কেও তাই খোঁজেন। এ ভদ্রলোক পারলেন না হাত মুঠি করতে। মানে সিভিডি।
সম্পর্কটা যে ‘প্যারালাইজড’ বুঝতে বুঝতেই অনেক সময় লেগে গেল। কোভিড, বাঁচা মরা, ঝড় ঝাপটা, একাকীত্ব- কোনকিছুতেই আর সংকোচন প্রসারণ হচ্ছিলো না। বুঝতেও পারছিলাম না। এখন সাদা কালো আকাশের এক বাফারিং স্টেট। আকাশ অনবরত বদলাচ্ছে। আতঙ্ক স্বাভাবিকতা খেয়ে নিয়েছে। ব্যস্ততা থেকে মুক্ত। এখন অনেক কিছুই ভেবে শেষ করা যায় যা আগে সময় নষ্ট মনে হতো। ভিক্ষুক দেখাও এক কাজ।
ভিক্ষুকরা এই যে সারাদিন ঈশ্বরের নাম নেয় তারা কী জানে না তাদের দুর্ভাগ্যের পিছনে কে দায়ী! এ পুরোটিই কী অভিনয়? আমার ধারণা বেশিরভাগ লোক তাই ভাবে। আসলে বেশিরভাগ লোক ভিক্ষুকদের নিয়ে চিন্তাই করে না। ভিক্ষাবৃত্তি প্রাচীনতম পেশা। সেখানে কিছু না করে অমন ধান্দাবাজির চিন্তা আসার কথা নয়। আমরা ঈশ্বরকে নিষ্কলঙ্ক- বিজয়ী- পূর্ণাঙ্গ ভাবতে পছন্দ করি। তাকে ভালোবাসি। সেজন্য মানুষকে অপরিপূর্ণ, কমজোরি, খুঁত সহ ভাল লাগে না। ভিক্ষুকরা সম্ভবত এ শিক্ষা দেয়- ঈশ্বরকে ভালোবাসতে হলে তার সৃষ্টিকে ভালোবাসতে হবে এবং সেটা খুঁতসহই বাসতে হবে।
মানুষ এ হেল্পকে করুণা দিয়ে ভাবছে যেটা ভালোবাসা নিয়ে ভাবা উচিত। কারো হাত নেই পা নেই সৃষ্টিকর্তার নাম নিচ্ছে ভালোবাসা দিয়ে পেইনটা ফিল করার কথা। যেখানে সাহায্য দিয়ে অসন্তুষ্ট থাকার কথা সেখানে করুণা দিয়ে সবাই ওভার স্যাটিসফায়েড!
আমরা ভাল করে ভালোবাসতেও শিখি নি।
কোভিড উনিশ অনেককিছুই কানে কানে বলে গেল। অন্তত সাদা কাগজে কিছু কালো ডট এঁকে গেছে- পরে আমরা কালি কলম দিয়ে অবয়বের উপর অবয়ব ভাসিয়ে নিয়েছি। সে অবয়ব গুলো আগেও ছিল, মিসিং লিংক গুলো ছিল না। কোভিড দিয়ে গেছে।
অসুস্থ ও দুর্বলের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি প্রমাণ করে আমরাও সবল নই। আমরাও অসুস্থ ও দুর্বল। আমরা যে ভাল করে ভালোবাসতেও শিখি নি!
.