লাইফ ইন লকডাউন, ডে হান্ড্রেড ফিফটি সিক্স

প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২০, বৃহস্পতিবার
ডা. শুভদীপ চন্দ

সক্রেটিসের মা ছিলেন ধাত্রী। তিনি প্রায়ই বলতেন তার শিক্ষাদানের কৌশল ধাত্রীর কৌশল। ধাত্রী নিজে বাচ্চা জন্ম দেয় না, বাচ্চা জন্মাতে সাহায্য করে। সক্রেটিসও তেমনি অন্তর্দৃষ্টি প্রসবে সাহায্য করেন। কিন্তু আগে উপলব্ধিটা ভিতরে আসা চাই। তিনি বলতেন ন্যায় অন্যায় বিচার মানুষ করবে, সমাজ নয়।

আড়াই হাজার বছর আগেকার সবচেয়ে জ্ঞানী লোকটি এক বর্ণও না লিখে জ্ঞানী। কারন কথাগুলো এখনো প্রযোজ্য। আমাদের সব অভাব উপলব্ধিতে। শিক্ষার অভাব নেই; অভাব নেই অর্থবিত্ত, বুদ্ধিবৃত্তির- কিন্তু কখনো দুইয়ে দুইয়ে চার হয় না।

ছবি – প্রতীকী

হাসপাতাল গুলো কত কায়দায় যে রোগী রেফার করে চিন্তার বাইরে। প্রায় সবাই হ্যান্ডসআপ!! ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল যেন সারাদেশের ডাম্পিং জোন। সবাই মাখনের মতো কেস চায়। যেখানে কো-মরবিডিটি থাকবে না, পার্টি পয়সাওয়ালা হবে, বোকাসোকা হবে। এক বেসরকারি হাসপাতালে বসে বসে দেখছিলাম আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান। ‘চিকিৎসাটা আমাদের এখানে হবে না’ প্রথমেই বলে দিতে পারলে কিছু বোনাস পয়েন্ট থাকে। পরবর্তীতে রোগী খারাপ হলে বেশি দায় রোগীর স্বজনের উপর বর্তায়। অর্থাৎ আস্থার অভাব দুই পাশেই। কেউ কাউকে উপলব্ধি করে না।

এ কিছুদিন আগে শহরের এক ভিআইপি রোগী ভর্তি করাতে গিয়ে বিপদে পড়ি। কেউ ভর্তি নিবে না কারণ ভিআইপি ম্যানেজ করা অনেক কঠিন। আমাদের রোগীর ক্লাসিফিকেশন রোগ দিয়ে হয় না, সোশ্যাল স্ট্যাটাস দিয়ে হয়। এক গর্ভবতী মা আসলো লেবার পেইন নিয়ে, সাথে বিশ পঁচিশ জন। সবাই সচেতন বিন্দুমাত্র অবহেলা যেন না হয়। এক উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্স এতো ভার কিভাবে বইবে! শুরু হলো নির্দয় অস্ত্র প্রয়োগ- কাউন্সিলিং। দারিদ্র্যের মহানুভবতা সে-ই বুঝে যে নিঃসঙ্কোচে সব বলতে জানে। ভিক্ষুকের হারানোর কিছু নেই, প্রাপ্তি ছাড়া। সে রোগী সে রাতে দরকষাকষির পর যখন বিদায় নিলো তখন তার প্রেশার তুঙ্গে। ক্যানুলাটিও করা হয় নি। আপনি বাঁচলে বাপের নাম।

প্রাচীন গ্রীসে অসুস্থতাকে স্বর্গীয় হস্তক্ষেপ বলে ধরে নেয়া হতো। ভাবা হতো অতিপ্রাকৃত কারনে মানুষ অসুস্থ হয়। যেমন ‘ইনফ্লুয়েঞ্জা’ শব্দের আসল অর্থ ‘গ্রহ নক্ষত্রের অশুভ প্রভাব’। এ যুগে আমাদের অসুস্থতা সত্যি সত্যি অতিপ্রাকৃতিক। নিয়তির অভিশাপ। তার পেছনে কেউ নেই পরিবার ছাড়া। চিকিৎসাকে সেবা হিসেবে না দেখে ব্যবসা হিসেবে দেখলে এ পরিস্থিতি কখনোই বদলাবে না।

কোভিডের এক নিজস্ব ভিন্ন দিক আছে। যা এর আগে দেখি নি। এক আত্মীয় আজ বলছিলো- ‘বাবার হার্টের অপারেশন না করে মাথার অপারেশন করা দরকার ছিল’! আমি বললাম- কেন? কেন?? বললো- ‘আগে জীবনেও মামাবাড়িতে আলাপ করতো না। এখন দুইবেলা করে ফোন দিয়ে জ্ঞান দেয়। এই নিয়ে মায়ের সাথে রোজ ঝগড়া হয়!!’ কত বিচিত্র কারনে যে বাঙ্গালি স্বামী স্ত্রী ঝগড়া করতে পারে লিখে শেষ হবে না। তবে কিছু দোষ সময়েরও আছে। কোভিড আগের ও কোভিড পরবর্তী পৃথিবী কখনো এক হবে না। দীর্ঘদিন বাসায় বন্দী থাকতে থাকতে বদলে যাচ্ছে মানুষের সব আচরণ।

অক্সফোর্ড ভ্যাক্সিন স্টাডি আপাত বন্ধ করা হয়েছে। এর আগে আরেক জায়ান্ট ফ্রান্সের সানোফি নিজেদের রেস থেকে সরিয়ে নিয়েছে। এ খবরগুলো ভীতি জাগানিয়া। এদিকে রাশিয়া তাদের দ্বিতীয় ভ্যাক্সিন নামাতে চাচ্ছে। আমেরিকা ও চীন ফিনিশিং লাইনের অনেক কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। দিনশেষে বিজ্ঞানের সুমিষ্ট ফলটুকুই ভাগ হয়, আর কিছু না।

আজ বাবাকে নিয়ে বের হয়েছিলাম। দীর্ঘদিন পর খোলা আকাশের নিচে এসে খুব খুশি। বললাম- ‘দেখো কোনো বয়স্ক মানুষ রাস্তায় নেই’। শহরের সৌন্দর্য প্রাচুর্যে। এখানে রাতের আকাশ ধরে রাখতে কেউ ক্যামেরা নিয়ে ছাদে উঠে না। ছাদে উঠে ছোট ছোট আলোক কণিকা দেখতে। এ আলো দেখেও এক শান্তি আছে। যত অভাব অভিযোগ থাকুক, যত মতভিন্নতা থাকুক- দিনশেষে সবার ফেরার মতো এক আশ্রয় আছে।

দুই গাল হাসি দেখার জন্য কত কষ্টই না করা যায়।

Platform

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

বিকল্প ছাড়াই কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতালের ডাক্তারদের আবাসন বাতিল

Thu Sep 24 , 2020
প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২০, বৃহস্পতিবার ডা. নূর ইসরাত                                                      ৩৯ বিসিএস, আইসিইউ মেডিকেল অফিসার, কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতাল৷ বাংলাদেশের প্রথম করোনা ডেডিকেটেড কুয়েত […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo