লাইফ ইন লকডাউন, ডে হান্ড্রেড সিক্সটি

প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২০, শনিবার
ডা. শুভদীপ চন্দ

ল্যাটিন ভাষায় একটি কথা আছে- mens sana in corpore sano, মানে সুস্থ দেহে সুস্থ মন। চীনাদের চেয়ে এ কথা বেশি কেউ জানে না। তারা যেমন অনেক কিছু ভাবতে পারে তেমনি শারীরিকভাবেও অনেক সুস্থ সবল। তারা কোভিড ভ্যাক্সিনকে নাকের স্প্রেতে আনতে চাচ্ছে। আবার একদম শুরুর দেশ হয়েও মোট আক্রান্ত পঁচাশি হাজার, ভারতে যেখানে এখন প্রতিদিন এক লক্ষ করে আক্রান্ত হচ্ছে।

আমরা চীনা কালচারে অভ্যস্ত নই তাই তাদের অনেক কিছু অস্বাভাবিক মনে হয়। পোশাক, স্বভাব, আচরণ- স্থান ভেদে ভিন্ন হয়। আমি আমার পজিশনে থেকে তাকে জাজ করতে পারি না। তার কাছে হয়তো এটাই স্বাভাবিক আমারটা অস্বাভাবিক। কে বোরকা পরলো কে টাইট পোশাক পরলো- সে আমি ‘অস্বাভাবিক’ বলার কে? আসলে মানুষের স্বভাবে সবকিছুই স্বাভাবিক। স্বাভাবিক অস্বাভাবিকের বিভাজন মনের ক্ষুদ্রতা থেকে জন্ম নেয়।

ছবি – প্রতীকী

গতকাল অনেকদিন পর হাসপাতালে গেলাম। ঢাকা থেকে সরাসরি। যাওয়া মাত্রই এক রোগীর ছেলে বললো ‘স্যার আপনাকে চারদিন ধরে খুঁজছি’। কারন মায়ের রিপোর্ট দেখাবে। আমি দেখলাম- এটি ক্যান্সার। খুব কঠিন এক ব্যাপার এ রোগ ডিজক্লোজ করা। এখানে ধরেই নেয়া হয় ক্যান্সার মানেই মৃত্যু। আমি বললাম- ‘যারা পরীক্ষা করেছে তারা কিছু বলে নি?’ বললো ওরা বলে দিয়েছে আমরা টেস্ট পাঠিয়েছি আমরাই বলবো। বুঝলাম এ বাজে দায়িত্বটা কেউ নিতে চাচ্ছে না। সব ডিশোল্ডারিং করে এখন আমার ঘাড়ে এসে চেপেছে। আমাদের এক স্টেশন ছিল ‘ব্রেকিং বেড নিউজ’- সেখানে শেখানো হতো কিভাবে এ দুঃসংবাদগুলো দিতে হয়। এক টিচার দেখেছিলাম কাউন্সিলিংয়ে পেশেন্টকে বলছেন ‘ক্যান্সার মানে জীবনের শেষ না, ক্যান্সার মানে এক নতুন জীবনের শুরু’। তিনি বলেছিলেন ‘ক্যান্সারের রোগীগুলো সাধারনের তুলনায় আরো বেশি পজিটিভ। তারা আরও বেশি জীবনকে বুঝতে পারে, জীবনের সৌন্দর্য অনুধাবন করতে পারে।’

তার নাম ছিল ‘আছিয়া বেগম’। আমাদের সব প্রেসক্রিপশন ইংলিশে হয়। দেখলাম ইংলিশে লেখা নাম ‘Mrs Asia Begum’। এ আছিয়া গুলোকে এশিয়া-ই লেখা হয়। এরকম কত মহাদেশ যে এ ছোট্ট দেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে- হিসাব কিতাব নেই! নামের বিচারে সবচেয়ে বড় প্রহসন সম্ভবত ‘সুশান্ত সিং রাজপুত’। ভদ্রলোক জীবিত বা মৃত কোন অবস্থাতেই শান্তি পেলেন না অথচ নাম ‘সুশান্ত’!!

আমাদের হাসপাতালে অক্সিজেন কনসেন্ট্রেটর গিফট করতে নেতৃবৃন্দ আসেন। কথা বলেন। আমরা হাততালি দেই। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি বললেন ‘এ উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্সই ঢাকা মেডিকেল কলেজ, পিজি হাসপাতাল’! আমরা আরও জোরে হাতে তালি দেই! বয়স্ক এক প্রতিনিধি ফেসশিল্ড মাস্ক পরে কী কী বললেন কিচ্ছু বোঝা গেল না। আমরা ‘ভাল কিছু বলেছেন’ এ বিশ্বাসে কিছু না বুঝেই হাততালি দেই। সামনে থেকে আমাদের সিনিয়ররা গ্যালন গ্যালন তেল ঢালেন। আমরা সিরিয়াস ভঙ্গিতে মাথা নাড়ি। লাইফ ডিমান্ডস কম্প্রোমাইজ- আমরা দাগ টাগ পেরিয়ে কম্প্রোমাইজ করি। জীবনটা আর ছোটবেলারকার রুলটানা খাতা নয়, সাদা খাতা। পুরো পৃষ্ঠা জুড়ে কম্প্রোমাইজ করার অবাধ স্বাধীনতা!

ফোন দেই যারা আগে নীতিশিক্ষা দিতেন। বলেন ‘ধৈর্য ধরো’। ভেবে দেখলাম ধৈর্য ধরাই সবচেয়ে বড় গুণ। জীবনটা যখন বাঁশবাগান, বাঁশের কাছ থেকেই শিক্ষা নিতে হয়। বাঁশ গাছ মাটির নিচেই কাটিয়ে দেয় চার পাঁচ বছর। তারপর যখন মাটি ফুড়ে বড় হওয়া শুরু করে চার পাঁচ সপ্তাহেই সব ছেড়েছুড়ে আকাশে উঠে যায়। চীনা বাঁশ গাছ নাকি পাঁচ সপ্তাহেই ৯০ ফুট পর্যন্ত বাড়তে পারে। বাঁশ গাছের কাছ থেকে ধৈর্য শিক্ষা নেই। শুধু ভয় হয় ধৈর্য ধরতে ধরতে মাটির নিচেই না পুরো জীবন পার করে দেই!

পৃথিবীতে যে কত রকম সমস্যা। বাড়ির মালিক স্বয়ংক্রিয়ভাবে পানি ছাড়ে না। রিকোয়েস্ট করলে ছাড়ে। মাঝে মাঝে আবদারের সুরে বলে ‘বাথরুমে বালতিতে পানি ভরে রাখবেন’। কারেন্ট আছে, মাস শেষে পানির টাকা দেই- বালতিতে কেন পানি ভরে রাখবো। তারা ট্যাংকি কখনো সম্পূর্ণ ভরেন না। তবু্ও ধৈর্য ধরে আছি কোনো একদিন তারা উপলব্ধি করবেন। কোটি টাকার বাসা। ছাদের উপরেও টাইলস, বাচ্চাদের জন্য পার্ক, পরিকল্পনায়ও আভিজাত্য। সব কৃচ্ছ্রব্রত শুধু পানি ছাড়ার বেলায়। বুঝি- অনেক টাকা ব্যয় করে ‘ছোটলোক’ হওয়া যায়, একবার ছোটলোক হলে আর বড়লোক হওয়া যায় না!

লালমনিরহাট থেকে ক্যুরিয়ার এসেছে। ডা মেহেনাজ তাবাসসুম দুইটি বই পাঠিয়েছেন। দুই লাইন লিখে দিয়েছেন। সম্পূর্ণ অজানা অচেনা একজন মানুষের প্রতি এতো শ্রদ্ধা এতো ভালোবাসা থাকতে পারে- কখনো ভাবি নি। খুশী হবো কী, সত্যি বলতে এ উপহার ছুঁতেও ভয় পাচ্ছি! কারন এরপর হয়তো আমি লিখতে পারব না। বারবার মনে হবে আস্তে-ধীরে লিখি। কারো প্রত্যাশার উপর যে হাঁটছি, যদি ভেঙ্গে যায়! তবু্ও চিৎকার করে বলি ‘ধন্যবাদ, খুব খুব ভাল থাকবেন’।

Platform

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

চিকিৎসকদের দাবিতে আবাসন সমস্যা সমাধান করলেন সোহ্‌রাওয়ার্দী হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ

Sat Sep 26 , 2020
প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২৬শে সেপ্টেম্বর, ২০২০, শনিবার রাজধানীর শের এ বাংলা নগরে অবস্থিত শহীদ সোহ্‌রাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সরকার নির্দেশিত পরিপত্রে বরাদ্দকৃত আর্থিক ব্যবস্থাপনার মধ্যেই কোভিডে ডিউটিরত অবস্থায় ও কোয়ারেন্টাইন সময়কালে চিকিৎসকদের জন্য মানসম্মত আবাসন ও নিরাপদ খাবারের ব্যবস্থা করেছে। চিকিৎসকদের নিরাপত্তা ও দাবির কথা মাথায় রেখে কর্তৃপক্ষের এমন আন্তরিক […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo