প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২০, বুধবার
ডা. শুভদীপ চন্দ
একটি ডায়েরি লেখা শুরু করেছিলাম লকডাউন ডায়েরি, কিছুদিন পর লকডাউন উঠে গেল। ডায়েরি কোভিড ডায়েরি হিসেবে টিকে রইলো। এখন কোভিডও যায় যায়, একে শুধু ডায়েরি হিসেবে টিকিয়ে রাখার মানে নেই। কিন্তু তারপরও এক তাগিদ তো থাকে। লোকে বলে করোনা তো এখনো পৃথিবী থেকে বিদায় হয় নি, ডায়েরি চলুক। আমি বলি মোমবাতি জ্বলে জ্বলে নিঃশেষ হলে যে ফল, ফু দিয়ে নিভালেও সে একই ফল- অন্ধকার। এ অন্ধকারের জন্য আর পরিশ্রম করে লাভ নেই!
লকডাউন উঠে গেছে কিন্তু আমাদের মানসিক লকডাউন যে শত বছর ধরে আছে তার কী হবে। এখানে আপনি কারো সম্বন্ধে নিন্দে করলে দেখবেন আপনি কোরাস গাইছেন, আর কারো প্রশংসা করুন দেখবেন একাই কথা বলছেন। শুধু তাই নয়, অদ্ভুত তুলনা-জ্ঞান এ জাতির। ‘মেয়েটি পড়াশোনায় ভাল’। সাথেসাথেই বলবে ‘হুমম, কিন্তু পড়াশোনাই কী সব’- মানে মেয়েটি শুধু পড়াশোনা ছাড়া বাকি সব কিছুতেই খারাপ। এক কথায় প্রায় মাটির নিচে পুতে ফেললো।
এখানে এক লোক আসে যার ত্রিশ বছর আগে তার একমাত্র ছেলে হারিয়ে গেছে। ত্রিশ বছর ধরে তার ঘুম হয় না, মাথা ব্যথা করে। এমন কোনো ডাক্তার নেই উনি দেখান নি এবং এমন কোনো ঔষধ নেই উনি গেলেন নি, কিন্তু সমস্যা কাটে না। প্রায় সবার প্রেসক্রিপশন উনি পকেটে নিয়ে ঘুরেন। এতো সময় কার আছে এতো কথা শোনার। আমরা শুনি না। আরো কিছু ঔষধ দেই। ঢাকায় যেতে বলি। আমাদের সমস্যা হলো আমাদের যেখানে কথা বলা প্রয়োজন সেখানে চুপচাপ থাকি, যেখানে চুপচাপ থাকতে হতো সেখানে আগেই কথা বলি, যেখানে অল্প কথাই যথেষ্ট সেখানে বেশি কথা বলি। এবং অপ্রাসঙ্গিক ও অহেতুক কথা বেশি বলি।
১৫৬ টি দেশ WHO এর নেতৃত্বে কোভিড ভ্যাক্সিন এর সুষম বন্টনে জোট বেধেছে। রাশিয়া বলছে তারা স্পুটনিক এর ১.২ বিলিয়ন ডোজের অনুরোধ পেয়েছে বিভিন্ন দেশ থেকে। এটিই বিজ্ঞান! রাশিয়ান চার্চে যখন প্রার্থনা হয় সে প্রার্থনার ভাগ কোন দেশ চায় না। কেউ ঈশ্বরের অনুগ্রহ সুষম বন্টনের দুশ্চিন্তায় জোটও বাধে না। যদিও এমন কথা স্কুল কলেজে পড়ানো হবে না। কি পড়ানো হবে সেটা সমাজ ঠিক করবে, বিজ্ঞানীরা নয়। ভারতে জীন বেসিস ডায়গনোসিস টেস্ট অনুমোদন পেয়েছে। দ্রুত এবং প্রায় নিখুঁত সনাক্ত করতে পারবে। নাম ‘ফেলুদা’। নামটি ভাল লেগেছে। করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমরা সত্যজিৎ রায়কেও পাচ্ছি!
ডিজি হেলথের এক ড্রাইভারের সম্পত্তির হিসেব পড়ছিলাম। এরকম কীর্তিমান খুব বেশি দেখা যায় না। মহর্ষি চার্বাক মুনি বলেছিলেন ‘ঋণ করে হলেও ঘি খাও। সে শোধ করতে হবে না কারন শরীরের পুণর্জন্ম হয় না।’ উনি শুধু ঘি না, হাতি ঘোড়া রাজ্যপাট সব খেয়ে ফেলেছেন। ডিজিতে আমি প্রকাশ্যে ‘খুশি হয়ে টাকা’ নিতে দেখেছি। আরও দেখেছি তালায় তালায় বড় করে ব্যানার ঝুলতে ‘দুর্নীতি মুক্ত প্রতিষ্ঠান’! সুকুমার রায় লিখে গেছেন ‘ছায়ার সঙ্গে কুস্তি করে গাত্রে হলো ব্যথা’। আমাদের দুর্নীতি বিরোধী কুস্তি অনেকটা এরকম।
…
ডিউটি চলছে। একের পর এক রোগী আসছে মিথ্যে কথা নিয়ে। একটি দেখার পর পরেরটি যখন দেখি মনেহয় একেই না দেখেছিলাম একটু আগে। প্লেটো যে ভাবজগতের কথা বলেছিলেন সেটিই বুঝি সত্যি। এরকম রোগী তৈরি হয়ে আছে মনের ভেতর। দশ বছর আগে আর পরে সবাইকে একজনই মনে হয়। মনে হয় সেইই যেন বারবার ঘুরেফিরে আসছে।
প্লেটো রাষ্ট্রকে মানবদেহের সাথে তুলনা করেছিলেন। মাথা, বুক, পেট মানবদেহের মূল তিনটি অংশ। মাথায় ধরে প্রজ্ঞা, বুকে ইচ্ছা, পেটে ক্ষুধা। আমাদের রাষ্ট্রে পেটের অংশটিই বড়। এতো বড় যে মাথা-বুক-হাত পা কিছু খুঁজে পাওয়া যায় না!