প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ৩ অক্টোবর ২০২০, শনিবার
ডা. শুভদীপ চন্দ
আমার আসা যাওয়ার পথে এক রেলগেট আছে। আজ বাস গিয়ে সিগনালে দাঁড়ালো। এ গেটকিপার অনেক কড়া ধাঁচের লোক। অনেকক্ষণ আগেই বাঁশ ফেলে দাঁড়িয়ে থাকেন। ট্রেনের পাত্তা নেই, ট্রেন আসবে পাঁচ মিনিট পর কিন্তু তিনি অবিচল। দুইপাশে গাড়ি জমছে, তিনি তাকিয়ে আছেন রেললাইনের দিকে- যেন যেকোনো মুহূর্তে ট্রেনের মাথা মাটি ফুড়ে বের হবে!
আমি উনার স্বভাব জানি। তাই একটু বিরক্তি নিয়ে বসে রইলাম। বাসের ভেতরে এক ছেলে চিৎকার করে উঠলো- ‘ট্রেন দেখবো, ট্রেন দেখবো’। ছেলে বাচ্চাদের বলে টডলার। এ টডলারদের মতো মজার জিনিস আর নেই। একবার এদিক যায় তো আরেকবার ওদিক যায়। ট্রেন আর আসে না। শেষে ড্রাইভারের পাশে বসে ট্রেন দেখলো। আমার বড়ভাইয়ের ছেলেটির বয়স দেড় বছর। টডলার। দুই চোখ বন্ধ করে চোখ টিপ দেয়!
শিশুদের অফুরন্ত প্রাণশক্তির উৎস -তাদের বিস্মিত হবার ক্ষমতা। অভিজ্ঞতার সবচেয়ে বাজে দিক হচ্ছে বিস্ময়শক্তি নষ্ট করে দেয়। ট্রেন- এত বড় গাড়িটা, এত এত চাকা, জানালা, দরজা দেখেও আমরা বড়রা অবাক হই না।
কোভিড কিংবা কোভিডাতঙ্ক এখন সারাদেশে কোথাও নেই। গ্রামেগঞ্জে কেউ মাস্ক পরে না। বাসে ট্রেনে এক জোড়া মাস্ক দশ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যে বিক্রি করছে সেও মাস্ক পরে না। এক লেয়ারের এ মাস্ক হুবুহু সার্জিক্যাল মাস্কের মতো। বাঙালির নকল করার প্রতিভা সত্যিই ঈর্ষণীয়।
এখন দুশ্চিন্তা বেশি রি-ইনফেকশন নিয়ে। সারা পৃথিবীই এ নিয়ে কনফিউজড। মেডিকেল প্রফেশনালদের মধ্যে রি-ইনফেকশন কেস প্রায়ই পাওয়া যাচ্ছে। করোনায় মারা গেলেন এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। ভদ্রলোক দেশের জন্য কি করেছেন না করেছেন সময় বিচার করবে। তবে এ কথা বলতেই হবে উনি উনার সময়ে বেঁচে ছিলেন।
আমি পুরো সুস্থ হই নি। তবুও আজ যেতে হয়েছে রোগী দেখতে। বৃহস্পতিবারের সময়গুলো বিক্রি হয়ে ছিলো। ডাক্তার অসুস্থ হতে পারে- এ কথা মানতে এ দেশের মানুষজন রাজি নয়। আমরা যাকে ব্যস্ততা বলি সেটি আসলে আধুনিক দাসত্ব। ক্লিনিকের মোলায়েম সুরটুকু আর থাকে না যখন জানে আপনি আসবেন না। আর পড়ে থাকা দুই আনায় রোগীদের প্রতি যে ডাক্তারের দায়বদ্ধতা সে নিয়ে কিছু না বলাই ভাল। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ অদেখা অল্পদেখা জিনিস নিয়ে বাঙালির মনে কখনো কাব্যরস সৃষ্টি করতে যান নি। সবচেয়ে মহান রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ সৈয়দ মুজতবা আলী সাক্ষ্য দেন- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কখনো শুভ্র তুষারপাত নিয়ে দুই লাইন লিখেন নি। তা সে যতই মনোমুগ্ধকর হোক। সেখানে আমি লিখে বাঙালি মনোজগতে ডাক্তারের প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধার বান এনে দিবো এমন ভাবা অন্যায় হবে। তারচেয়ে বলি ভাগ্যদোষেই আজ শরীরের উপর উঠে রোগী দেখলাম। বাসায় এসে তাই আবার শয্যাশায়ী।
…
সময় চলে যাচ্ছে ডায়েরির পাতা ভরার মতো। অপ্রয়োজনীয় সব লেখা। বলিউডের খবর পড়ি। ট্যালেন্টেড সব শিল্পীঃ সুশান্ত সিং রাজপুত, দিপীকা পাডুকোন, সারা আলী খান, শ্রদ্ধা কাপুর, হৃত্বিক রোশনরা নাকি ড্রাগ এডিক্টেড। কঠিন পুলিশী জেরা চলছে। এরপর এসব সর্বনাশা নেশার বিরুদ্ধে সুপারহিরোদের আর পাওয়া যাবে না। আসলে সেলিব্রেটিরা সবসময় দূর থেকেই সুন্দর। আমাদের দেশেও সম্ভবত প্রায় কাছাকাছি অবস্থা হবে। ঢাকার বড় বড় হাসপাতালের ডাক্তাররা কিন্তু অনেক কিছু জানেন। কখনো শেয়ার করেন না। কারণ আড়াই হাজার বছর আগের এক শপথ নিয়ে তারা ডাক্তার হয়েছেন। একা একা যখন ভাবি, মনে মনে বলি এও কম স্বস্তির কথা নয়!
এরিস্টটল বলেছেন সুখ তিন ধরনের। প্রথম ধরনের সুখ হচ্ছে আনন্দ এবং উপভোগের জীবন। দ্বিতীয় ধরনের সুখ হচ্ছে মুক্ত এবং দায়িত্ববান নাগরিকের জীবন। তৃতীয় ধরনের সুখ হচ্ছে একজন চিন্তাবিদ ও দার্শনিকের জীবন। উনার মতে পরিপূর্ণ সুখী হতে হলে জীবনে একই সঙ্গে তিন ধরনের সুখ-ই থাকতে হবে! কঠিন শর্ত তবে সম্ভবত অসম্ভব নয়!!
অসম্ভবই হয়তো; নইলে এতো কিছু পেয়েও এরা সুখী নন কেন! মেধা, আনন্দ, দায়িত্ব কোনকিছুরই তো এদের অভাব নেই।