প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২০, শুক্রবার
ডা. শুভদীপ চন্দ
যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে তিন কিশোর নিহত হওয়ার খবর পড়লাম। এসব খবরে আর কান্না আসে না। আমার এক ছোটভাই মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রে আছে। আচ্ছা, বারান্দায় যে গাছটিতে রোদের অভাবে ফুল ফুটছে না- আমরা কী সে গাছ তুলে ফেলে দেই? না টবের পজিশন পাল্টে গায়ে রোদ পানি লাগানোর ব্যবস্থা করি! তবে এদের ক্ষেত্রে কেন এমন হয় না? এ প্রত্যেক ঘটনার জন্য, প্রত্যেক নষ্ট হওয়া ভবিষ্যতের জন্য কম বেশি আমরা দায়ি।
সূর্য যখন মেঘের আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছিলো- আমরা তখন ছাতা দিয়ে মাথা ঢাকছিলাম। যেন ঝড়ের কোনো ঝাপটা গায়ে না লাগে! চিরদিনই দেয়ালের ছায়া ধরে মাটির দিকে তাকিয়ে হাঁটা আমার অভ্যাস। তাই পৃথিবীর কোনো কাজে আসি না।
গতকাল কোভিড টেস্ট দিলাম। আজ যেহেতু ফোন আসে নি সুতরাং নিগেটিভ। শুনেছি পজেটিভ হলে তিন চার জায়গা থেকে ফোন আসে। বাসার কাছে হাসপাতালে না গিয়ে দূরে নিজের কর্মস্থলে গিয়েছিলাম। এভোয়েডেন্স-কে খুব ভয় লাগে। রোগটিই এড়ানোর কিন্তু সহ্য হয় না। দেখলাম আমাদের উপজেলায় স্যাম্পল কালেকশন হয় ঘরের বাইরে। একটি পঁচা পুকুরের পাশে। অনেকজন গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে আছে। অর্ধেকেরই মাস্ক নেই। কেউ বোরকা দিয়ে, কেউ আঁচল দিয়ে, কেউ ওড়না দিয়ে নাক চেপে আছে। করোনার ভয়ে না পঁচা পুকুরের গন্ধে- বুঝতে পারলাম না। অল্প যে কজন মাস্ক পরেছে- মাস্ক সরিয়ে শ্বাস নিচ্ছে। পজিটিভ নিগেটিভ রিপোর্ট নিয়ে কারো ভাবনা নেই, সবাই চাচ্ছে আগে স্যাম্পল দিতে। সুস্থ মানুষ সেখানে গিয়ে অসুস্থ হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। কোরিয়া সফল হয়েছিল স্রেফ টেস্ট করে। তারা রাস্তার মোড়ে মোড়ে স্যাম্পল কালেক্টরকে বসিয়ে দিয়েছিল। আমরা এখনো হাসপাতালেই স্যাম্পল কালেকশন জাতের বানাতে পারলাম না। স্বাস্থ্যবিধি তো বহুদূর।
আমেরিকান বিজ্ঞানীরা কোভিড উনিশ সিম্পটমের একটি ধারাবাহিকতা আবিষ্কার করেছেন। সব অসুখেরই একটি করে নিজস্ব হাইওয়ে থাকে। এখানে প্রথমে জ্বর আসবে, তারপর কাশি, তারপর শরীর ব্যাথা, বমি বমি ভাব বা বমি, ডায়রিয়া। কারো যদি ডায়রিয়া প্রথমে হয় বুঝতে হবে অবস্থা একটু বেশিই খারাপ। সার্স মার্সের সাথে এ সিম্পটম ধারাবাহিকতা দিয়ে পার্থক্য করা যায়। জরিপে দেখা গেছে সবচেয়ে বেশি রোগী এসেছে জ্বর নিয়ে। তারপর কাশি/ শ্বাসকষ্ট, তারপর ডায়েরিয়া নিয়ে।
কোভিড একটি ভাল কাজ করেছে। এর মাধ্যমে সায়েন্টিফিক রেস আবার চালু হলো। সে জাতীয়তাবাদের নামেই হোক বা ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্যই হোক। রাশিয়ান ভ্যাক্সিনের নাম ‘স্পুটনিক’ দেয়ার পেছনে আর কোনো তাৎপর্য থাকতে পারে না। তারা দুই মাসের মধ্যে ফেজ থ্রি ট্রায়াল না করেই ভ্যাক্সিন বাজারে ছেড়ে দিছে। বিশ্বাসযোগ্যতা প্রমাণে প্রেসিডেন্ট পুতিন তার মেয়েকে দাওয়ায় তুলেছেন। ছোটবেলায় পরীক্ষার হলে দেখতাম কারো কারো মূল খাতা আগেই শেষ হয়ে যেতো। দাঁড়িয়ে বড় গলা করে পেজ চাইতো। বাকিরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইন্টারলাইন গ্যাপ আরো বাড়িয়ে দিতো। আমরা এসব দুর্নীতি ছোটবেলা থেকেই শুরু করি। এরজন্য বড় হয়ে আমাদের কোনো সমস্যা হয় না। দ্রুত সিস্টেমের সাথে অভ্যস্ত হয়ে যেতে পারি। কখনো দেখি নি অহেতুক পৃষ্ঠা নষ্ট করার জন্য কোনো টিচার কাউকে কম মার্কস দিয়েছেন। বরং এজন্য বেশি মার্কস দেয়ার উদাহরণ ভুরিভুরি। যাইহোক রাশিয়ান এ তাড়াহুড়ো পেজ চাওয়ার স্মৃতিকে মনে করিয়ে দিলো।
এখন পর্যন্ত ৩০ টি ভ্যাক্সিন হিউম্যান ট্রায়ালে আছে। তারমধ্যে ৮ টি আছে ফেজ থ্রি মাস ট্রায়ালে। আরো ১৩০ টি ভ্যাক্সিন ক্লিনিক্যাল পর্যায়ে আছে। তারমানে বার্সেলোনা ভার্সেস বায়ার্ন মিউনিখের ফুটবল খেলার চেয়ে এখন পৃথিবীর কাছে এসব স্ট্র্যাটেজি বেশি গুরুত্বপূর্ণ! তবে যতই দ্রুত গবেষণা হোক এ বছরের শেষ বা সামনের বছরের শুরু ছাড়া সৎ উপায়ে ভ্যাক্সিন পাওয়া যাবে না। ভারতের দুই ভ্যাক্সিনও আর্লি হিউম্যান ট্রায়ালে আছে।
একজন ভারতীয় বংশদ্ভূত আমেরিকান ভাইস প্রেসিডেন্ট ক্যান্ডিডেট হয়েছেন। নাম কমল দেবী হ্যারিস। কমল শব্দের মানে পদ্ম। শেক্সপিয়ার বলেছিলেন- ‘এ রোজ বাই এনি আদার নেম উড স্মেল এজ সুইট’। ফুলের নামে কারো নাম শুনলেই আমার এ কথাটি মনে পড়ে। মনেহয় ও ফুলের নাম যদি ‘গোলাপ’ না হয়ে ‘মকড়’ হতো তবে তার নামও কী ‘মকড়’ হয়ে যেতো! বংশদ্ভূতদের নিয়ে কোনো আগ্রহ পাই না, গর্বের কারণও বুঝি না। উনার নাম ফুলের নামে এটি একটি খবর হতে পারে। কিন্তু উনি ভারতীয়, পাকিস্তানি না ইতালিয়ান- তাতে কী পার্থক্য হয়!
মাছের নাম কাজলি। মাইছার নাম নিরঞ্জন। কাজলি মাছ অনেক সুন্দর। ঝলমল করে আলোয়। সব ছোট ছোট। নিরঞ্জন বললো- ‘বড় কাজলি পাবেন কই? কাজলি বড় হবে কার্ত্তিকের শেষে’। আমি মনেমনে ১৪ ই এপ্রিল থেকে গোনা শুরু করলাম। যথেষ্ট কঠিন। নিরঞ্জনের সহকারী চিন্তিত ভঙ্গিতে সিগ্রেটের ধোঁয়া ছাড়ে। তার হাতে আঙ্গুলের চিপায় তাড়ি তাড়ি টাকার নোট। পাঁচশো টাকা, একশো টাকা, খুচরা টাকা।
বাজারে আরও আছে ইলিশ মাছ। গত সপ্তাহ থেকে দাম বেশি। বরফের মাঝে একটু মাথা বের করে রাখে। ইলিশ মাছে এক রাজকীয় ভাব আছে। সাথে মায়াবী গন্ধ। দোকানের লাইট তার ঘাড়ের উপর জ্বলে। সৈয়দ মুজতবা আলী বলেছিলেন ‘সরু চালের ভাত আর ইলিশ মাছ ভাজার চেয়ে উপাদেয় খাদ্য আর কিছুই হতে পারে না’। এ কথায় দ্বিমত পোষণ করায় তাঁর এক বন্ধুস্থানীয় পাঞ্জাবি মৌলানার সাথে তিনদিন কথা বলা বন্ধ রেখেছিলেন। উনার মতে ইলিশ মাছকে কেউ অপমান করলে তার মুখদর্শন করাও মহাপাপ!!
তবে পৃথিবীতে মাছেরাই সবচেয়ে ভাগ্যবান। বুড়া হওয়ার অপমান গায়ে মাখতে হয় না। বড় অথবা ছোট। আর পার্থক্য হয় জন্মস্থানে- পুকুর, নদী, বা বিলের মাছ। লাউ কিনতে, ঢেঁড়স কিনতে, মাংস কিনতে আমি নাকি সব বুড়া গুলো তুলে নিয়ে আসি। মাছের ক্ষেত্রে এমন অভিযোগ কেউ কোনদিন করে নি।
মাছেরা কী আসলেই বুড়া হয় না- না কী- কিছুই বুঝি না!