প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২০, রবিবার
ডা. শুভদীপ চন্দ
সবচেয়ে বড় অপরাধীগুলো থাকে ঘরে। অন্যায়কে নীতি-নৈতিকতা-আদর্শ-রীতির মোড়কে প্রেজেন্ট করে। বাইরের বাটপার অন্তত নিঃস্বার্থ ঠকায় না। ঘরের বাটপার ভালর কথা বলে ঠকায়। সেজন্য আমার সংসারে আগ্রহ কম। কাউকে না ঘাঁটালে কেউ ঘাঁটাতে আসবে না। বাইবেলে যেমন আছে ‘judge not, that ye be not judged’ কারো বিচার করো না, ঈশ্বরও তোমার বিচার করতে আসবেন না।
আমি যখন গেলাম, বৃদ্ধ বামকাত হয়ে আছেন, চোখ অর্ধেক খোলা, মুখও খোলা। মারা গেছেন বেশ কিছুক্ষণ হয়। হাসপাতালে ভর্তি করতে বলেছিলাম চারদিন আগে। নগরীর পানিবদ্ধতার জন্য ছেলেরা ভর্তি করে নি। তারও আগে ঢাকায় নিয়ে কিছু টেস্ট করাতে বলেছিলাম, করোনার দোহাই দিয়ে সেও করাতে পারলেন না। বেশিরভাগ মৃত্যুই ‘হত্যা’, মৃতব্যক্তি জবানবন্দি দিতে পারে না বলে আত্মীয় স্বজন সব বেঁচে যায়।
সমস্যা হচ্ছে ভাষা পণ্ডিতের হাতে তৈরি হয় না, সাধারণের মুখে তৈরি হয়। পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্র সমার্থক শব্দ অথচ আপাতদৃষ্টিতে দুইটি দুই মেরুর। একি কাজ- হেরে গেলে ‘ষড়যন্ত্র’ আর জিতলে ‘পরিকল্পনা মাফিক’। আমি বললাম ‘পরিকল্পনা সফল হয়েছে। উনি এক্সপায়ার করেছেন’। প্রথম লাইন কেউ শুনলো না কারন দ্বিতীয় লাইনের জন্য সবাই অপেক্ষা করছিল। কান্নার রোল নেমে এলো। এক দুইজন স্বান্তনা দিচ্ছিলো, এক দুইজন মোবাইল বের করে দূরে চলে গেল।
এখানে সবই পুঁজি। ভাগ্য, দুর্ভাগ্য, সম্পদ, বিপদ, স্থিরতা, অস্থিরতা, বল, কমজোরি, আশীর্বাদ, অভিশাপ- সব পুঁজি। শুধু আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে কোনটি দিয়ে ব্যবসা শুরু করতে চান। গ্রামের মানুষ সবচেয়ে বেশি বলে অসহায়ত্বের কথা, কিন্তু সে অসহায়ত্ব থেকে বের হয়ে আসার তারা কোনো প্রচেষ্টা করে না। শুধু ওরা না, সবক্ষেত্রেই। সুযোগ পেলে সুযোগের সদ্ব্যবহার বাঙালি জাতির মতো খুব বেশি জাতি করতে পারবে না।
ভদ্রমহিলা অসুস্থ। ডুকরে ডুকরে অসুখের ফিরিস্তি দেন। তার স্বামীর ভাল রোজগার। ইচ্ছে করলেই তাদের আয়ের সামান্য টাকা বেতনের এ চাকরি ছেড়ে দিতে পারেন, কিন্তু ছাড়বেন না। কারন সরকারি চাকরির মতো এমন অক্ষয় দুধেল গাই আর নেই। প্র্যাগনেন্সি, বাচ্চা ছোট, বাসায় বাচ্চা রাখার লোক নেই, ছেলেকে স্কুল থেকে আনতে যেতে হবে, শ্বশুর শ্বাশুড়ির জন্য ঢাকায় থাকতে হয়- কত অজুহাত যে হতে পারে এ দেশে! আমার এক বন্ধু সরকারি চাকরি হওয়ার আগে বলছিল ‘মহাবিশ্বের যে প্রান্তেই দিক চাকরি করবো’। তার নিজের গ্রামে তার পোস্টিং হয়েছিল, যায় না। কয়েকদিন পর ফেসবুক বিপ্লবী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলো। এখন ডাক্তার ক্যাডারের অনিয়ম বঞ্চনার সকল তথ্য তত্ত্ব তার মুখে মুখে। চোখ বন্ধ করে লাইক দিই।
এক সরকারি অফিসে গিয়ে কর্মকর্তাদের এতো শিশুবাচ্চা দেখেছি- আমার কাছে ‘অফিস’ মনে হয় নি, কিন্ডারগার্ডেন মনে হয়েছে! সে অফিসে মহিলা কর্মকর্তা বেশি ছিলেন। রুমের মধ্যেই আটমাসের বাচ্চাকে ঘুম পাড়াচ্ছিলেন। কাজ কী হবে!
..
ঝোপের মতো গাছ। সাদা সাদা ফুল। আমি জিজ্ঞেস করলাম ‘কি ফুল?’ মেয়েটি বললো ‘কামিনী’! ‘কামিনী?? কিন্তু কামিনী তো শরতের ফুল, বর্ষায় পাবেন কেন?’ ‘কামিনী বর্ষার ফুল।’ ‘আচ্ছা এটিই তো সে ফুল যে ছুঁয়ে দিলে ঝড়ে পড়ে যায়, আঙ্গুলে গন্ধ লেগে থাকে। রবীন্দ্রনাথ একে নিয়ে কবিতা লিখেছেন।’ ‘কামিনী ফুল চেনেন না, রবীন্দ্রনাথ পড়ে বসে আছেন!’
মেয়েটি চলে গেল। কামিনী ফুল কেন কোনো ফুলই আমি খুব ভাল চিনি না। মনে রাখতে পারি না। ফুল চিনতে হয় গন্ধ দিয়ে। পড়েছিলাম ইউরোপীয়দের ফুল খুব বেশি চাকচিক্যময়, কিন্তু গন্ধশুন্য। আমাদের ফুল দেখতে সাধাসিধে তবে গন্ধের বাহার। হবে হয়তো। দেশ ছেড়ে কোনদিন কোথাও তো যাই নি।