প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২০, সোমবার
ডা. শুভদীপ চন্দ
গুজরাট সরকার WHO র কাছে একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। সেখানে তারা বলছে- গুজরাটে অর্ধেকের বেশি মানুষকে ফ্রি হোমিওপ্যাথিক ঔষধ বিতরণ করা হয়েছিল। যাদের ৯৯.৬ শতাংশ কোভিড নিগেটিভ। হোমিওপ্যাথিক ঔষধ আসলে কতটা কাজ করে প্রশ্নসাপেক্ষ। তবে এ রিপোর্ট মাথা ঘুরিয়ে দেয়ার মতো।
একটি খবর দেখলাম চীনে পোকার কোষে কোভিড ভ্যাক্সিনের প্রোটিন ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। পোকা চাষের সাথে সাথে ভ্যাক্সিনও তৈরি হচ্ছে। বানরের উপর প্রয়োগের পর ভ্যাক্সিনটি ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের অনুমোদন পেয়েছে। এর কোনো সাইড ইফেক্ট নেই।
কত অদ্ভুত কিম্ভুত খবর যে এ কোভিড কালে ঘুরে বেড়ালো- ইয়ত্তা নেই। যে যেভাবে পারে পজিটিভিটি ছড়ানোর চেষ্টা করেছে। ছোটখাটো স্টোরিগুলো আলোচনাতেই আসে নি। আমার এক কলিগ করোনা নিয়ে ঢাকার হাসপাতালে ভর্তি। সে ভর্তি, তার বাবা ভর্তি, তার মা পজিটিভ। হঠাৎ রাত তিনটা সাড়ে তিনটায় এক রোগী খারাপ হয়ে গেল। সিস্টার পিপিই পরে আসতে আসতেই সে এক্টিভেট হয়ে যায়। রোগীটির স্যাচুরেশন তখন ৬০ এর মতো নেমেছিল। তার কুইক কারিকুরিতে রোগী ফিরে আসে। আমাদের কোয়ারেন্টাইন শেষে ডিউটি শুরু হয়েছে। গতকাল সে ফোন দিয়ে ‘স্যরি’ বলছিল। আমি বললাম- ‘ডিউটি তো করছোই, স্যরি কেন!’ এরকম অনেক কথা লেখা হয় নি। ভাল হয়েছে একদিক থেকে। আবেগ বেগকে নষ্ট করে!
আজ রোগী দেখার ফাঁকে ফাঁকে ম্যাটসের এক ইন্টার্নি স্টুডেন্টের সাথে কথা বললাম। তারা মেডিকেল এসিস্ট্যান্ট। তিন বছর পড়াশোনা করেছে, এখন এক বছর ইন্টার্নি। ইন্টার্নিশিপ শেষে সার্টিফিকেট পাবে। এ এক বছরের নয় মাস সদর হাসপাতালে তিন মাস উপজেলায়। তারা আসে ডিউটি করে। নয় মাসের জায়গায় বারো মাস পনেরো মাস খাটিয়ে নেয়া হয় তাদের। অথচ এক টাকাও নাকি পে করা হয় না। উল্টো তাদের এককালীন বারো চৌদ্দ হাজার টাকা দিতে হয়েছে। বললাম ‘চলে কি করে?’ বলে ‘স্যার চালাতে হয়!’ বের হওয়ার পর কি করবে- জানে না। আপাতত এক ফার্মেসিতে বসার প্ল্যান।
এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট, হাবিজাবি ট্রিটমেন্ট, ভুয়া ডাক্তার- অনেক কথা বলি আমরা। খুব সহজ দূর থেকে সমালোচনা করা। সরকারি হাসপাতালে কাজ করছে, সার্ভিস দিচ্ছে- বেতন ভাতা নেই। অথচ যখন তারা চালাকি করে রোজগারের উপায় বের করছে- তখন বলছি ‘চোর’! যে সন্তানের প্রতি মমতা দেখাবেন না সে সন্তান জন্ম দিতে গেলেন কেন?
কোভিড উনিশে অনেক দেশ তার স্বাস্থ্যখাতকে নতুন ভাবে গড়ে নিয়েছে। আমাদের উচিত কিছু দেশপ্রেমী সিদ্ধান্ত নেয়া। এসব কোর্স এখন বন্ধ করে দেয়া যেতে পারে। এমনকি এমবিবিএসও সংখ্যায় কমিয়ে আনা যেতে পারে। অত অত বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেশে প্রয়োজন আছে কিনা- ভাবা যেতে পারে।
এখন কোভিড পরীক্ষার রিপোর্ট দুইদিনেই দিয়ে দিচ্ছে। মোবাইলে এসএমএসও দিচ্ছে। আমাদের ধারনা আমরা পজিটিভ হয়ে নিগেটিভ হয়ে গেছি। সেরো স্টাডি না করে এ বুঝা যাবে না। গণহারে সবার স্যাম্পল স্টাডি শুরু করতে পারলে বেশ হয়। ইতোমধ্যে অনেক ডেডিকেটেড হাসপাতাল রোগীর অভাবে বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। বাসের ভেতর ছাড়া আর কোথাও এখন সামাজিক দূরত্ব রক্ষা হচ্ছে না। আজ এক সেনাবাহিনীর গাড়ি দেখলাম। পিছনে ছয় আটজন জোয়ান গাদাগাদি বসে আছেন। বাইরে ব্যানার ঝুলছে ‘সামাজিক দূরত্ব মেনে চলুন’। গাড়িটি জ্যামের কারনে আটকে ছিল। ছবি তুলতে পারলে বেশ হতো, পুরো দেশের যেন প্রতিচ্ছবি।
সেলিব্রিটি সবসময় দূর থেকে সুন্দর। কারন হাসি কান্না দুঃখ বিষাদ যা কিছুই আসুক, একজন সেলিব্রেটি-ই শুধু পারেন তার ভেতর থেকে ‘লাইক’ আদায় করে নিতে। আবেগের মূল্য তাদের কাছে এক লাইকের বেশি নয়। সম্প্রতি এক ক্রিকেটারের মেয়ের ছবির ইস্যুতে এ সত্য আবার প্রকাশ পেল। যারা কমেন্ট গুলোর সমালোচনা করছিলেন তারা চাচ্ছিলেন একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন হোক। এমনতর ঘটনা যেন এ দেশে আর না ঘটে। কিন্তু সেলিব্রেটি দেখলেন তুলাযন্ত্রে একদিকে ভর নেমে যাওয়া মানে অপরদিক উঠে যাওয়া। তিনি থামিয়ে দিলেন। এরা কেউ এদেশে থাকবেন না। শুধু পুঁজিটা এদেশের। পরদেশের বিড়ম্বনা কেউ ঘাড়ে নিতে চায় না!!
…
গিফটে প্রয়োজন থাকতে নেই, গিফটে থাকবে সারপ্রাইজ। প্রয়োজন মেটানোর উদ্দেশ্য নিয়ে যা কেনা হয় তাকে বলে ‘বাজার’। বই পড়ার অবসর নেই। তিন চার বই মাঝপথে আছে। এরমাঝে ফেসবুক বন্ধু বিমান ধর তার লেখা বইটি পাঠালেন। বইয়ের নাম ‘ডাকবাস্কের খোঁজে’। এতো খুশি কখনোই হয় নি। আমি ভেবে রেখেছি হাতের বইটি শেষ করেই এ বই খুলবো। তিনি চিঠি লিখতেন একজনকে। সেখান থেকে বাছাই করা চিঠি নিয়ে বই। চিঠি থেকে বই হয়েছে বা এমন হতে পারে- ভাবতেই পারি নি কখনো!
আমাদের ডিউটি রুমের জন্য ফ্রিজ এসেছে। প্রতিদিন গিয়ে বাস্কবন্দী ফ্রিজ দেখি। আমাদের এসি আছে অথচ জানালা ভাঙ্গা। বেসিনে পানি নেই আবার ঘরে ফ্রিজ আছে। এক কোনায় দোতালা থেকে মহিলা ওয়াশরুমের পানি চুঁয়ে চুঁয়ে পড়ে। যেকোনো সময় ছাদের পলস্তারা খসে পড়তে পারে। ভাঙ্গা জানালা গলে এতো মশা ঢুকে যে বসা যায় না। এ ফ্রিজ দিয়ে কি করবো- ভাবি। ফ্রিজ দেখি আর ভাবি!
অনেক কষ্ট করে পড়াশোনা করে সরকারি চাকরি পেতে হয়। তারপর একবার সরকারি চাকুরি হয়ে গেলে আর স্বাভাবিক মানুষে ফেরত আসা যায় না। স্বাভাবিক মানুষ হলে হয়তো ফ্রিজ কেনার আগে অন্যকিছু বেশি প্রায়োরিটি পেতো। এভাবেই দেখে শুনে মুখ বুজে চলছে জীবন।