প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ১৯ নভেম্বর ২০২০, বৃহস্পতিবার
ডা. শুভদীপ চন্দ
পরিচিত এক বৃদ্ধ মারা গেলে অন্য বৃদ্ধরা এমনিই সামনে আসেন না। ভয়ে! এবার বুঝি তার ‘সময়’ চলে আসলো। কিন্তু তিনি আসলেন। আসতে বাধ্য হলেন। ছেলেরা এমন নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করছিলো, এমন অর্থের বাদানুবাদ করছিলো, ইশারা ইঙ্গিত দিচ্ছিলো যেন কাজটি পরে পরে হয়ে যায়।
লাশ এভাবে হাসপাতালে আর কতক্ষণ ফেলে রাখা যায়! বৃদ্ধই টাকা বের করলেন। মৃতের ছোটভাই তিনি। তিন ছেলে গোঁয়ারের মতো দাঁড়িয়ে আছে। তাদের বউয়েরা প্রতিযোগিতা করছে- কে কার চেয়ে বেশি জোরে কাঁদতে পারে। এ পরিবারগুলো আমি জানি। সূক্ষ্ম মান অভিমানের দেয়াল দিয়ে পৃথক হয়ে থাকে। এ ঘর, ও ঘর আলাদা হতে সময় নেয় না। মিল হতেও সময় নেয় না। যখন মুখ দেখাদেখি বন্ধ হয় একজন আরেকজনের ছায়াও মাড়ায় না। দীর্ঘ দুই বাড়ি ঘুরে রাস্তায় উঠে। শুনিয়ে শুনিয়ে নিন্দে চর্চা করে। প্রচণ্ডভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে বাসার ছোটরা যেন ও বাড়ির ছোটদের সাথে না মিশে। তারপর যখন মিল হয় তারা ভুলে যায়। কী জিনিস কবর দিয়ে তারা ফুল ফোটাচ্ছে তারা ভুলে যায়। এ চুলার রান্না ও চুলায় ঢোকে। এ ঘরের টিভির আওয়াজ ও ঘর থেকে শোনা যায়। তারা কি- আবার মনে হওয়ার আগ পর্যন্ত তাদের দুঃখবোধ ঘুমিয়ে থাকে। তারা ছোটলোক। প্রচণ্ড ছোটলোক।
দুই মুচি দীর্ঘক্ষণ ঝগড়া করছে এ বাড়ির স্যান্ডেল জুতা কেন অন্য মুচি কালি করলো? শ্বাশুড়ি আধাপট চালের জন্য, এক শিশি তেলের জন্য, এক চামুচ গুড়া সাবানের জন্য অনেক কথা শোনাতে পারেন। সামান্য এক টাকা, দুই টাকার জন্য তারা ঘন্টার পর ঘন্টা ঝগড়া করতে পারে। একটু ভাত বেশি খেলে তারা কথার আঘাতে রক্তাক্ত করে দেয়। গা জ্বালানো কথা কাকে বলছে- শ্বাশুড়ি, ছেলের বৌকে, ননদকে না একসাথে বড় হয়ে ওঠা ভাইকে তারা ভাবে না। অতি অল্পতে বেঁচে বেঁচে তাদের অভ্যাস, অল্পই তাদের জন্য অনেক। পাঁচ দশ পরিবার ঘিঞ্জি করে যে বসতি তার ছাদ ফুটো করে আলো ঢুকে না। অভাব আর অপ্রাপ্তির যে দেয়াল তা ভেঙ্গে বাতাস আসে না। সেখানে রুচিবোধ, আধুনিকতা, উৎকর্ষতা বাহুল্য। মনসাগরের ঐশ্বর্যের খোঁজ তারা কখনো পায় নি, তার অনুসন্ধানের চেষ্টাও তারা কখনো করে নি। হৃদয় উজাড় করে দীনতা দেখানো, পকেট উপুড় করে শূন্যতা বোঝানো, চিৎকার করে লোক জড়ো করে চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তা বোঝানো- এখানে অতি স্বাভাবিক ব্যাপার। আমাদের চোখে অস্বাভাবিক ঠেকে তা, আমাদের ছানিপড়া চোখের দুর্বলতা।
এক সূক্ষ্ম অনুভূতি তার মাঝে থেকেও সবাইকে এক ঘরে বেঁধে রেখেছে। ছবিগুলোতে শুধু পাশাপাশি মুখ আসে, ভেতরের কেমিস্ট্রি আসে না। যে কেমিস্ট্রি প্রয়োজন দিয়ে বোনা হলেও বোনা। এভাবেই মারা যাবেন গনি মিয়ারা, এভাবেই এক আউন্স তেল বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে বিল্ডিং তুলবেন সখিনা বেগমরা, এভাবেই লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম করবে মন্তু টুনিরা। যেখানে প্রেম মানে আগ্রহ, বিয়ে, যৌনতা আর সন্তান উৎপাদন। এগুলো সাহিত্য না হলে ক্ষতি নেই।