হিজরা দের প্রতি ছোট বেলা থেকেই বিরূপ ধারণা বা মনোভাব নিয়ে আমরা বেড়ে উঠি। এদের সম্পর্কে কোন প্রকার সঠিক তথ্য আমাদের দেশের উচ্চ শিক্ষিতরা এমনকি অনেক ডাক্তাররা পর্যন্ত দিতে পারেন না। আমাদের দেশে এখনো পর্যন্ত প্রজনন এবং লিঙ্গ নির্ধারণ ভিত্তিক কথাবার্তা খুব ভীতি সহকারে এবং গোপনে আলোচনা করা হয় যার কারণে এরকম ব্যাপারগুলো খুবই স্পর্শকাতর বলে ভাবা হয়। এসবের ফলে আমরা দ্বিধাদ্বন্দে থাকি এরকম ব্যাপারে। তবে নন কন্সারভেটিভ মানসিকতার জিজ্ঞাসু মানুষদের জন্য ডাঃ আসির মোসাদ্দেক সাকিবের এই সহজ ব্যাখ্যামূলক লেখা।
পৃথিবীতে পুরুষ ও স্ত্রীলিঙ্গ নামক দুই প্রকার লিঙ্গ যুক্ত মানুষ থাকলেও মানুষের জটিল দেহ গঠনে মাতৃগর্ভে বাচ্চার লিঙ্গ জেনেটিক্যালি নির্ধারিত হবার সময় লক্ষ জন মানুষের ভেতর দুএকটা ভুলচুক হয়ে যায় মাঝে মাঝে। এটা বুঝার আগে আমাদের আগে প্রানী জগতের কয়েকটা বিশেষ প্রজনন পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে হবে। প্রথমে যে জিনিস টা বলব সেটার নাম “পার্থেনোজেনেসিস”।
আমরা জানি স্বাভাবিক ভাবে শুক্রাণু ডিম্বাণু মিলিত হলেই নতুন প্রাণের উদ্ভব ঘটে। কিন্তু পোকামাকড়দের অনেক এমন প্রজাতি আছে (যেমন পিঁপড়া, মৌমাছি ইত্যাদি) যাদের ডিম্বাণুতে এমন একটা স্পেশাল ক্ষমতা থাকে যেটার সাহায্যে তারা শুক্রাণু ছাড়াও নিজ থেকেই বাচ্চা জন্ম দিয়ে দিতে পারে। ডিম্বাণুর এরকম নিজ থেকেই বাচ্চা উৎপাদনের পদ্ধতিকে পার্থেনোজেনেসিস বলে আর উৎপাদিত প্রাণীকে পার্থেনোকার্পিক প্রাণি বলে। এ ধরণের পোকা মাকড়ের উভয় রকম বাচ্চা হয়। যেসব বাচ্চারা শুক্রাণু ডিম্বাণু মিলিত হয়ে তৈরি হয় তারা হয় মেয়ে পোকা আর যারা খালি ডিম্বাণু থেকেই তৈরি হয়ে যায় তারা হয় ছেলে পোকা। আমরা যেসব মৌমাছি কে ফুলে ফুলে ঘুরতে দেখি বা দেয়ালে দেয়ালে আনাচে কানাচে যত পিঁপড়া দেখি সবাই মেয়ে। ছেলেদের কারো বাবা থাকেনা, শুধু মা থাকে। এদের ছেলে হয় খুব কম এবং এরা সাইজে ছোট এবং এরা তাদের তৈরি বাসায় রানীকে শুক্রাণু দান করতেই থেকে যায়। এই হল পার্থেনোজেনেসিসের কথা।
এবার হল বলব উভলিঙ্গ প্রাণির কথা। এদের ইংরেজিতে hermaphrodite বলে। গ্রীক পুরাণে দেবতা হার্মিস আর দেবী আফ্রোদিতির এক বাচ্চা এরকম ছেলে মেয়ে উভয়ের লিঙ্গ নিয়ে জন্মেছিল ধারণা করা হয় বলে এদের দুইজনের নাম মিশিয়ে এই ধরণের প্রাণীকে হার্মাফ্রোডাইট বলা হয়। হার্মাফ্রোডাইট রা দুই রকমের। সিকুয়েন্সিয়াল আর সাইমোল্টানিয়াস অর্থাৎ পর্যায়ক্রমিক ও সমসাময়িক। সিকুয়েন্সিয়াল দের প্রজননতন্ত্র বছরে কিছু সময় ছেলেদের মত ও কিছু সময় মেয়েদের মত থাকে। অর্থাৎ বছরে এরা একবার মা হতে পারে এবং আরেকবার বাবা। বহু মাছ,পাখি আর উদ্ভিদ প্রজাতি এরকম পর্যায়ক্রমিক লিঙ্গ বদল করতে পারে এবং এটা স্বাভাবিক। সাইমোল্টানিয়াস বা সমসাময়িকরা একই সাথে দেহের দুই স্থানে দুই বিপরীত লিঙ্গ ধারণ করে। এদের উৎকৃষ্ট উদাহরণ হল কেঁচো। এদের একই প্রাণির দেহে দুই বিপরীত লিঙ্গ থাকলেও এরা স্বপ্রজনন করেনা। এরা একই সাথে বাবা এবং মা হতে পারে। এই দুই প্রকারের বাইরে আরেকটা অতিরিক্ত প্রকারভেদ আছে যাকে Psudohermaphrodite বা মিথ্যা হার্মাফ্রোডাইট বলে। এটার উদাহরণ হল হায়েনা। হায়েনাদের পুরুষাঙ্গ দেখতে স্ত্রীদের মত এবং স্ত্রীঅঙ্গ দেখতে পুরুষাঙ্গের মত। দেখতে বিপরীত মনে হলেও আসলে এরা উভলিঙ্গ নয় তাই এদের সিউডো বলা হয়।
এই গেল প্রাণীদের কথা। এখন আসি মানুষের কথায়। উপরোক্ত ভাবে মানুষের দেহে লিঙ্গ বদল বা অসম্পুর্ণভাবে গঠিত লিঙ্গ দেখা গেলে এদের আগে “মনুষ্য হার্মাফ্রোডাইট” বলা হত। পশু পাখি এবং উদ্ভিদে এই লিঙ্গ বদল স্বাভাবিক হলেও মানুষে এটা অস্বাভাবিক। বিগত বছর খানেক যাবত এই ধরণের অদ্ভুত লিঙ্গ বিশিষ্ট মানুষদের হার্মাফ্রোডাইট বলে সম্বোধন করা আন্তর্জাতিকভাবে নিষেধ করা হয়েছে। এদের নতুন নাম দেয়া হয়েছে INTERSEX ।
আমরা যাদের হিজরা বলে চিনি তারা মোটেও এই ইন্টারসেক্স না। ইন্টারসেক্স মানুষ সম্পুর্ন অন্যরকম জিনিস। আমরা যারা বিজ্ঞানের ছাত্র ছাত্রী তারা জানি যে ছেলেদের লিঙ্গ নির্ধারনের ক্রোমোজোম xy আর মেয়েদের xx । জন্মের আগে মায়ের পেটে আমাদের ক্রোমোজোম বিন্যাসের সময় হঠাৎ কিছু গোলযোগ হয়ে যায়। বিশেষ করে লিঙ্গ নির্ধারনকারী ক্রোমোজোমে এই গোলযোগ হলে xx বা xy না হয়ে xxy বা xxx বা x0 বা xyy এরকম হতে পারে। বিজ্ঞানীরা ৫ ধরণের ক্রোমোজোমাল অস্বাভাবিকতা চিহ্নিত করেছেন এরকম ইন্টারসেক্স হবার জন্য। সেগুলো হল Androgen insensitivity syndrome ; Klinefelter syndrome; Turner syndrome; congenital adrenal hyperplasia এবং Ovotestis ।
আবার এধরনের অনেক রোগীর দেহের বিলিয়ন বিলিয়ন কোষের অর্ধেকে xx এবং বাকি অর্ধেকে xy ক্রোমোজোম থাকে। এদের জিন বিন্যাসকে মোজাইক জেনেটিক্স বলে। এ ধরণের রোগ নিয়ে জন্মালে কিছু অদ্ভুত জিনিস দেখা যায়। হয়তো জন্মের পরে মানুষটির দেহ দেখতে হবে মেয়ের মত কিন্তু এর জননাঙ্গ হবে ছেলেদের মত যা ১০/১২ বছর পরে অদ্ভুত ভাবে ধীরে ধীরে পরিবর্তন হতে হতে স্ত্রী অঙ্গে পরিবর্তিত হয়ে মানুষ টা পুরাই মেয়ে হয়ে যাবে অথবা জন্মের সময় ছেলের মত হয়ে গঠন হয়ে জননাঙ্গ হবে মেয়ের মত যা পরে ছেলেদের মত হয়ে যাবে অথবা এদের কোনটাই না হয়ে অদ্ভুত এক প্রকারের জননাঙ্গ নিয়ে জন্ম হয় যা পুরুষাঙ্গও না স্ত্রীঅঙ্গও না। একে ambiguous genitalia বলে। এই জননাঙ্গ পরবর্তিতে হয়ত পুরোপুরি ছেলেদের মত বা পুরোপুরি মেয়েদের মত হয়ে যাবে। তবে ছেলে বা মেয়ে যাই হোক না কেন এদের প্রজনন ক্ষমতাহীন হবে। কিন্তু এ ধরণের ঘটনা পশু পাখিতে বা উদ্ভিদে হলে এরা সম্পূর্ণ প্রজননক্ষম হয়। এটা মানুষের সাথে তাদের পার্থক্য। তাই বর্তমানে মানুষের ক্ষেত্রে এদের intersex ও না বলে disorder of sexual development(DSD) বলছেন জিন বিজ্ঞানীরা। আমরা অনেক সময় গ্রামেগঞ্জে বা কোন স্কুল কলেজে কোন ছেলে মেয়ে হয়ে যাবার বা মেয়ে ছেলে হয়ে যাবার ঘটনা হয়তো শুনে থাকব। শুনেও হয়তো এত দিন বিশ্বাস করতাম না। তবে এখন থেকে জেনে রাখব যে এরা ইন্টারসেক্স বা DSD প্রজাতির মানুষ।
এবার আসি “হিজরাদের” প্রসঙ্গে। আমি এতক্ষণ যে ইন্টারসেক্স মানুষের কথা বললাম তারা অনেক সময় নিজেদের হিজরা বলে পরিচয় দেয় এবং তাদের দলে গিয়েও থাকে। কিন্তু এটা আসলে ভুল। সব ইন্টারসেক্সরা হিজরা না। হিজরা হল একটা অদ্ভুত মানসিক সমস্যার রোগী। এই রোগের নাম Gender Dysphoria বা Gender identity disorder(GID)। এর জন্য আমাদের আগে transgender কথাটি বুঝতে হবে। transgender রা এমন মানুষ যারা মানসিক দিক থেকে নিজেদের যা ভাবে শারীরিক দিক থেকে ঠিক তাঁর বিপরীত হয়। অর্থাৎ কেউ যদি ছেলে হয় তারা ভাবে যে আসলে তারা মেয়ে এবং যারা মেয়ে হয় আসলে তারা ভাবে যে তারা ছেলে। এরাও কিন্তু একধরণের ইন্টারসেক্স। তবে ইন্টারসেক্স রা নিজেদের লিঙ্গ নিয়ে সন্তুষ্ট থাকে আর ট্রাসজেন্ডাররা সন্তুষ্ট থাকেনা। তারা তাদের লিঙ্গ নিয়ে খুবই অস্বস্তি বোধ করে। ট্রান্সজেন্ডারদের এই মানসিক সমস্যার নাম Gender Dysphoria । অনেক ট্রান্সজেন্ডার নিজেদের ছেলেও মনে করে মেয়েও মনে করে। এদের bigender বলে। আবার অনেকে নিজেদের কোন লিঙ্গই ভাবেনা যাদের agender বলে। ট্রান্সজেন্ডাররা নিজেকে বিপরীত লিঙ্গ ভেবে ছেলেরা মেয়েদের পোশাক আর মেয়েরা ছেলেদের পোশাক পরে থাকে যাদের cross dresser বলে। এগুলা সবাই ট্রান্সজেন্ডারের অন্তর্ভুক্ত। তবে আসল হিজরা হল যারা ছেলে হিসেবে জন্ম নেয় কিন্তু নিজেদের মেয়ে মনে করে। গত এপ্রিল ২০১৭ তে আন্তর্জাতিক মানসিক রোগ সংস্থা অনুসারে এই মানসিক সমস্যাটা dual role transvestism এর অন্তর্গত করা হয়। আবার আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক এসোসিয়েশন এই Gender Dysphoria কে সরাসরি মানসিক সমস্যা মনে করেনা।
হিজরা শব্দটি উর্দু হলেও উৎপত্তিগত ভাবে সিমেটিক এরাবীয় । “হিজর” বা যাকে আমরা হিজরত বলি সেটা থেকেই হিজরা শব্দের উৎপত্তি। এই হিজর এর অর্থ নিজ গোত্র ত্যাগকারী। পরিবার এদের তাড়িয়ে দেয় বলে এদের হিজরা বলা হয়। ইংরেজিতে eunuch বা hermaphrodite বলে একে। এদের ভারতের বিভিন্ন স্থানে আরাভানি, আরুভানি, জাগাপ্পা ইত্যাদি নামেও ডাকা হয়। তামিল ভাষায় থিরুনাংগি বা চাহাক্কা বলা হয়। উপমহাদেশে এদের স্বীকৃতি বহু বছর না থাকায় এরা মূলত দেহব্যাবসার কাজে জড়িত থাকত গোপনে। তাছাড়া ভিক্ষা, ছিনতাই ইত্যাদি বিভিন্ন কাজে জড়িত থাকতে হয় তাদের ইনকামের জন্য। হিজড়াদের যৌনসঙ্গীকে “কথি” বলা হয়। এই কথিরা সমকামী হয়। বাংলাদেশে এই কথি দের “পন্থি” বলে ডাকা হয়। দিল্লীতে বলে “গিরিয়া” কোচিনে বলে “শ্রিধর” নেপালে বলে “মাতি” পাকিস্তানে বলে “জেনানা” । প্রাচীন ভারতের বাৎস্যায়নয়ের লেখা বিখ্যাত “কামসূত্র” বইতে এই হিজড়াদের “তৃতীয়া প্রকৃতি” বলে সম্বোধন করা আছে। তৎকালীন রাজারাজড়াগণ হিজরা দের অন্দরমহলে প্রহরী হিসেবে রাখত। হিজড়াদের একটা আলাদা ভাষা আছে হিজরা ফারসি নামে। যেসব হিজরা তাদের লিঙ্গ কেটে ফেলে তাদের “নির্বান” বলা হয়।
১৮৭১ সালে বৃটিশরা এদের “অপরাধী সম্প্রদায়” বলে আইন করার পর থেকে এদের দুর্ভোগ শুরু হয়। বিংশ শতাব্দী তে এসে উপমহাদেশের দেশগুলো এদের জাতীয় স্বীকৃতি দেয়া শুরু করলো। পাকিস্তান আর ভারত ২০১৩ তে এদের নাগরিক বলে স্বীকৃতি দেয়। ভারত নিজেদের পাসপোর্টে এদের জন্য আলাদা কাগজ লাগিয়েছে। পাকিস্তানে এরা রাজনীতিতেও অংশ নিচ্ছে। ২০১৩ তে পাকিস্তানের নির্বাচনে সানাম ফকির নামক এক ৩২ বছর বয়স্ক হিজরা স্বতন্ত্র্য প্রার্থী হিসেবে দাঁড়ায়। ২০১৪ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের সুপ্রিম কোর্ট এদের সম্পুর্ন নাগরিক হিসেবে মর্যাদা দিয়ে আইন জারি করে। এদের তৃতীয় লিঙ্গের নাগরিক হিসেবে ভোটার তালিকা করার অধিকার দেয়া হয়। শিক্ষায় এদের অগ্রাধিকার দেয়া হয়। এদের নিয়ে বহু নাটক সিনেমা বই লেখা আছে। বিভিন্ন ধর্মে এদের নিয়ে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি প্রচলিত আছে। সে সব নিয়ে আমি আলোচনা করব না।
সবার উপরে এরাও আমাদের মত মানুষ। শুধু মনটাই বিধাতা একটু ভিন্ন করে দিয়েছেন। বাকি আবেগ অনুভূতি হাসি কান্না আনন্দ বেদনা সব আমাদেরি মত।
লিখেছেনঃ ডাঃ আসির মোসাদ্দেক সাকিব, চমেক।
ছবি ঃ বিবিসি