আজকে আমরা যেই গল্পটি সম্পর্কে জানবো তার জন্যে আমাদের যেতে হবে ২৩৫ বছর পেছনে , ১৭৮৩ সাল । ইংল্যান্ডের এক ঐতিহ্যবাহী , সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম নেন রবার্ট মিটফোর্ড । তাঁর পারিবারিক ঐতিহ্যের স্বরূপ হিসেবে ইংল্যান্ডের নর্দাম্বারল্যান্ডে আজও মিটফোর্ড দুর্গ ( Mitford Castle) দাঁড়িয়ে আছে সগর্বে । পিতা জন মিটফোর্ড তৎকালীন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন । লন্ডনে পড়ালেখা শেষ করে ১৭৯৮ সালে যোগ দেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে রাইটার হিসেবে যোগ দিয়ে ভারতবর্ষে পাড়ি জমান । বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন পদে চাকুরি করে তিনি ১৮১৬ সালে ঢাকা জেলার কালেক্টর ও প্রশাসক হিসেবে আসেন ।
তিনি যখন ঢাকায় আসেন তখন ঢাকার অবস্থা খুবই করুণ । আগের সব ঐতিহ্য বিলীন হয়ে গিয়েছে ততদিনে । জনজীবনে নেমে এসেছিলো চরম দুর্দশা । অনেকেই তখন ঢাকা ছেড়ে গ্রামে চলে গিয়েছিলো । বিভিন্ন মহামারী , রোগ-শোক আর ক্ষুধা হাজার মানুষকে ঠেলে দিয়েছিলো মৃত্যুর মুখে । এই করুণ চিত্র রবার্ট মিটফোর্ডের মনে গভীর রেখাপাত করে । ১৮২১ সাল পর্যন্ত অত্যন্ত সফলতার সাথে দায়িত্ব পালনের পর ১৮২১ সালে তিনি ঢাকা প্রভিন্সিয়াল কোর্ট অব আপিল এন্ড সার্কিটের দ্বিতীয় জজ নিযুক্ত হন । ১৮২৮ সালে তিনি অবসরে যাওয়া পর্যন্ত এই পদেই ছিলেন । প্রায় ত্রিশ বছর ভারতবর্ষে অবস্থান করার পর অবশেষে তিনি স্বদেশভুমি ইংল্যান্ডে ফিরে যান ।
কিন্তু তাঁর পরবর্তী জীবন খুব একটা সুখকর ছিলো না । এমনি এক ব্যক্তিগত ও পারিবারিক বেদনাদায়ক অবস্থার মধ্যে ১৮৩৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ২১ তারিখ তাঁর মৃত্যু হয় । কিন্তু মারা যাবার আগে মিটফোর্ড একটি উইল করে যান । উইলের কয়েকটি ধারায় মিটফোর্ড তাঁর সম্পত্তি বন্টনের কিছু নির্দেশ দিয়ে যান । উইলের অষ্টম ধারায় তিনি তাঁর ঘোড়াগুলি দেখাশোনার জন্যে বাৎসরিক একটি তহবিল করার নির্দেশ দেন । আর নবম ধারায় ঢাকা সংক্রান্ত বিখ্যাত নির্দেশ লিপিবদ্ধ করেন , ” উইলে উল্লেখিত সবাইকে দেওয়ার পর অবশিষ্ট যা থাকবে তা ঢাকার অসহায় মানুষদের উপকারে ব্যয় করা হবে ” কিন্তু রবার্টের এই উইল অনেকেই মেনে নিতে পারেননি । বিশেষ করে তাঁর স্ত্রী যার সাথে রবার্টের কখনোই খুব একটা সুসম্পর্ক ছিলো না তিনি লন্ডনে হাইকোর্টের চ্যান্সারি বিভাগে মামলা করেন । তাঁর কৌসুলি উইলের নবম ধারাকে বিপর্যয়ে ফেলার চেষ্টা করেন । ১৮৩৮ সালে ঢাকাবাসীর পক্ষে রায় আসলেও আপিলের কারণে মামলা আরও দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকে । অবশেষে ১৮৫০ সালে চূড়ান্ত রায়ের পর প্রায় ১,৬০,০০০ টাকা বাংলা সরকারকে দেওয়ার জন্যে ভারত সরকারের কাছে পাঠানো হয় । তখনকার দিনের জন্যে এটি ছিলো চিন্তার বাইরে একটি টাকার অঙ্ক ।
এতগুলো টাকা দিয়ে কি করা যায় তা নিয়ে টাকা আসার আগেই জল্পনা কল্পনা শুরু হয়ে গিয়েছিলো । অবশেষে লর্ড ডালহৌসি নেন সিদ্ধান্ত । তখন ডালহৌসির চোখে নতুন ভারতবর্ষ গড়ার স্বপ্ন । ১৮৫২ সালের ৪ অক্টোবর তিনি এক চিঠি লিখেন যা আধুনিক বাংলাদেশের এক ঐতিহাসিক দলিল এবং মিটফোর্ড হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার দিক নির্দেশধারী । তিনি মিটফোর্ড হাসপাতালকে কেবল একটি হাসপাতাল হিসেবেই দেখেননি বরং এই অঞ্চলের সামাজিক ও স্বাস্থ্য ক্ষেত্রের এক বিপ্লব সৃষ্টিকারী অনুঘটক হিসেবেও দেখতে চেয়েছিলেন । একটি মজার ব্যপার হলো তখন মিটফোর্ডের মাত্র দুটি ঘোড়া জীবিত ছিলো । কিছুদিনের মধ্যে ঐ ঘোড়া মারা যাবার পর বাংলা সরকার আরও প্রায় ১৮,৫০০ /- টাকা পায় । ১৮৫৪ থেকে ১৮৫৮ সাল । বুড়িগঙ্গার পাড়ে তৈরী হয়ে গেলো ১০০ মানুষকে সেবা দিতে পারার মত মূল হাসপাতাল ভবন । কিছুদিন পরে হাসপাতাল প্রাঙ্গণটিকে একটি বাগানের রূপ দেওয়া হয় । হাসপাতালের পুরো পরিবেশ তখন বেশ আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে । ১৮৫৮ সালের ১ মে , যখন সিভিল সার্জন এসে নতুন মিটফোর্ড হাসপাতাল ভবনে রোগীদের দেখাশোনা শুরু করলেন সেই সময় থেকে পূর্ববাংলার ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের শুরু হলো ।
Courtesy: Humans of Mitford
https://www.facebook.com/humansofmitford/