সামারা তিন্নি
ঢামেক, কে-৬১
২০০৩-২০০৪
যারা ছাত্র তাদের দুঃখ বোঝার জন্য অন্তত কয়েক হাজার মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকেন। কিন্তু শিক্ষকদের কষ্ট বোঝে কে? আধা ঘণ্টা মাত্র ব্রেক নিয়ে এক টানা ছয় ঘণ্টা ক্লাস করা যেমন সুখকর কিছু নয়, ক্লাস নেয়াটাও কি এমন মধুর হাঁড়ি! জীবনের এক সময় আপনি থাকবেন ডেস্কের ওইপাশে আর বেলা বাড়লে চলে আসবেন এই পাশে – চিরন্তন নিয়ম। কিন্তু আমি যখন ওইপাশে ছিলাম তখন এইপাশের শিক্ষকের মনে মনে কি চলতো সেটা এখন বুঝতে পেরে আমার তো চক্ষু চড়কগাছ। সামনে বসে কেউ হাই তুললে যে এত হতাশ লাগে সেটা তো আগে বুঝিনি! তারচেয়েও হতাশ হই যখন আমার নিজের ঘুম ঘুম লাগে অথচ ভাব করতে হয় যে নিউরোলজির মত এমন মধুর বিষয় পৃথিবীতে আর দু’টি আসেনি।
.
মানুষের মেমোরি গোল্ডফিস মেমোরি থেকেও খারাপ। এক অবস্থান থেকে অন্য অবস্থানে যাওয়া মাত্র চটজলদি সে ভুলে যায় সেও একসময় বিপরীতে বসা মানুষটির স্থানেই ছিল। একারণে শিক্ষকতা যেবেলা শুরু করেছিলাম সেবেলা ঝালিয়ে নিয়েছিলাম নিজের অতীত। ঠিক তেমন একজন হতে চেয়েছিলাম যেরকম শিক্ষক আমি চেয়েছিলাম আমার ছাত্র জীবনে। বজ্র আঁটুনি ফসকে গেঁড়ো নয়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, আমার কাজ কারবার পাশ করা ডাক্তারদের নিয়ে। ফার্স্ট ইয়ারের তারুণ্যে ভরা ছেলে মেয়ে পড়ানো এক ব্যাপার, আর বিশ বছরের প্রাকটিস করা ডাক্তারকে পথ দেখানো আরেক। প্রথম যে হোঁচটটা খেলুম তা হচ্ছে যে ভাবে সে সব কিছু জানে, তাকে পড়ানোর মত কঠিনতর কাজ পৃথিবীতে আর নাই।
.
আমি এএমসি পড়ানো শুরু করেছি ২০১৬ থেকে। হাসপাতালের চাকরি সামলে পড়াতে যেতে কষ্ট হয়, তাও ছাড়িনি কারণ পড়াতে আমার ভালো লাগে। সুতরাং বলা যায় প্রায় আড়াই বছর ধরে পড়াচ্ছি। ছাত্র সবাই আমার মত বৈদেশি ডাক্তার, অর্থাৎ যারা অস্ট্রেলিয়াতে এমবিবিএস পাশ করেনি। যেহেতু ইউকে অথবা উন্নত আরো দেশ থেকে বলতে গেলে প্রায় সরাসরি অজিল্যান্ডে কাজ করার পারমিশন আছে (শুধু পার্ট ওয়ান পাশ করলেই হয়) তাই পার্ট টুতে আমার বেশিভাগ সময় কাজ করতে হয় অনুন্নত বা আধা উন্নত দেশের ডাক্তারদের নিয়ে। আরো নগ্ন করে বললে, আমার মত গায়ের চামড়ার মানুষদের নিয়ে। বিভিন্ন দেশের মানুষদের সাথে মিশে আমি খেয়াল করলাম, পৃথিবীতে যত ডাক্তার আছে তার মাঝে সবচাইতে বেশি বোঝা ডাক্তাররা হচ্ছে আমাদের উপমহাদেশের ডাক্তাররা। কারণ তারা যখন ক্লাসে ঢোকে এবং তাদের চেয়ে বয়সে ছোট একজনকে টিউটর হিসেবে দেখে, তারা প্রথমেই ধরে নেয় “এ কি আমার থেকে বেশি জানে?” বরং নর্থ আমেরিকা, ভেনিজুয়েলা, চৈনিক দেশ ইত্যাদি থেকে আসা ডাক্তাররা অনেক সহনশীল। তারা তর্ক করেন কম, রেফারেন্স চান বেশি। আমার সহগোত্রের ভাই ব্রাদাররা নিজেদের জীবনের অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে তর্ক করেন, রেফারেন্সের ধার ধারেন না।
.
এক ভারতীয় ডাক্তার আমাকে প্রশ্ন করেছিল, “কেন আমি রয়াল চিলড্রেনের গাইড লাইনে যা লেখা সব বিশ্বাস করবো?” এখানে প্রসঙ্গত উল্লেখ্য রয়াল চিলড্রেন হাসপাতালের গাইডলাইনকে বাইবেল ধরে এখানে চিকিৎসা দেয়া হয়। এরকম উদ্ভুইট্টা কথা জিজ্ঞেস করার মত মানুষ আছে বলেই অস্ট্রেলিয়ায় হেলথ সিস্টেম সম্পর্কে এত দুর্নাম। এরা নিজেদের দোষ স্বীকার করেন না, বদনাম দেন যে এএমসি পরীক্ষা কঠিন অথবা একচোখা। যা হোক, আমি হাসতে হাসতে সেই ডাক্তারকে বলেছিলাম, যে দেশের গাইডলাইনে তার আস্থা নেই সে দেশকে সর্বাগ্রে পরিহার করে তার নিজ দেশে ফিরে যাওয়া দরকার। এতে করে দুই দেশেরই জীবন বাঁচে। দ্বিতীয় ক্লাসে তিনি আমাকে চ্যালেঞ্জ করে বসলেন যে কেন আমি যে টিপসটি তাকে দিচ্ছি সেটি তিনি বিশ্বাস করবেন, নিজ প্রাকটিসে তো উনি অন্যটি করেন। আবারো হাসতে হাসতেই বললাম, আমার কাজ হচ্ছে ছাত্রদেরকে সেই পথ দেখানো যেটাতে তাদের এএমসি পাস হবে। ডাক্তারি শেখানোর দায়িত্ব তাদের মেডিকেল স্কুলের। আমি আমার কাজ করে যাবো, আপনার ইচ্ছে হলে পাস করবেন নতুবা বছর বছর পরীক্ষা দেবেন। আমার তাতে কিছুই যায় আসেনা। বলাই বাহুল্য ভদ্রলোক এর পর থেকে আমার আর একটি ক্লাসেও কোন উদ্ভট প্রশ্ন করেননি। কারণ আমাদের চামড়ার আরেকটি বিশ্রী ব্যাপার হচ্ছে আমরা শক্তের ভক্ত নরমের যম। ভদ্রতাকে দুর্বলতা ভাবা আমাদের জন্মগত অভ্যাস।
.
তো পড়াতে পড়াতে আরেকটি জিনিস আবিষ্কার করলাম। ঠিক আবিষ্কার করলাম বলা ঠিক হবে না, কারণ আমার ডাক্তার বাবা আমাকে এই কথা আগেও বলেছিলো কিন্তু আমি বিশ্বাস করিনাই। কথাটা হচ্ছে, বেশিরভাগ ডাক্তার ডাক্তারি ছাড়া কিছু জানে না এবং জানার আগ্রহও নাই। পড়াতে গেলে উদাহরণের প্রয়োজন হয়। উদাহরণের জন্য দরকার হয় মজার মজার ঘটনা, নতুবা ক্লাসটা ঠিক উপভোগ্য হয় না। তখনি আমি আবিষ্কার করলাম যে উপমহাদেশের ডাক্তাররা না পড়েন কোন বই, না দেখেন তেমন কোন সিনেমা। গানের কথা তো বাদই দিলাম। সান বার্নের স্টেজ পড়াতে পড়াতে ঠিকমত বোঝানোর জন্য বললাম হ্যাং ওভার সিনেমার রোদে পুড়ে চিমসে হওয়া নায়কের অবস্থা। ক্লাসে উপস্থিত পঁচিশজনের মাঝে শুধু একজন খিক খিক করে হাসলো, বাকিরা তব্দা খেয়ে বসে রইলো। দুই একজনকে দেখলাম মোবাইলে সার্চ দিচ্ছে। একজনকে ধরে বললাম, “শেষ মুভি কবে দেখেছো?” সে আমতা আমতা করে বললো, “এএমসি পড়ার চাপে কিছু করার সময় পাই না” – শুনে আমি তব্দা খেয়ে গেলাম। ভয়ে আর জিজ্ঞেস করতে পারলাম না যে বই টই কিছু পড়ার সুযোগ হয় কিনা।
.
একদিন ক্লাসে তাড়াতাড়ি চলে যাওয়ায় আড়মোড়া ভেঙে বই পড়ছিলাম। এক পাকিস্তানি ডাক্তার ক্লাসে ঢুকে আমাকে পড়তে দেখে খুব আগ্রহ নিয়ে শুধালো যে কি বই পড়ি। বই এর নাম শুনে সে খুব অবাক হয়ে বললো, “দিস ইজ নট আ মেড বুক।” আমি তারচেয়ে অবাক ভাব গলার স্বরে ফুটিয়ে বললাম, “খেয়ে কাজ নাই আমি বগলে করে মেডিসিনের বই নিয়ে ঘুরবো কেন?” সে মাথা চুলকে বললো, “লাভ কি পড়ে?” আমি হেসে দিয়েছিলাম। যে জন প্রশ্ন করে বই পড়ে কি লাভ, তাকে কি উত্তর দেয়া যেতে পারে? কারণ উনি যে লাভের আশা করছেন, তা কিছুই এই বই থেকে আসবে না। স্টিফেন কিং এর বই এ দুঃখ আছে, হতাশা আছে, ভালোবাসা আছে, অশরীরি প্রেতাত্মার রক্তজল করা হুংকার আছে – কিন্তু এতে লাভ নেই এক বিন্দু।
.
সমস্ত দিন লাভযুক্ত বই পত্র পড়ে আর অসংখ্য মানুষের দুঃখ কষ্টের কথা শুনে শুনে আমরা যে মানসিক অত্যাচারের ভেতর দিয়ে যাই তা আমরা কেউ স্মীকার করিনা। একটি মানুষকে মৃত হিসেবে ঘোষণা করা এবং তার পরিবারকে গিয়ে সেই খবরটি দেয়া যে কি পরিমাণ মেন্টাল স্ট্রেস সৃষ্টি করে সে সম্পর্কে আমরা কোন কথাই বলি না। একটি ক্রিটিকাল রোগী আমাদের দায়িত্বে থাকলে ডিউটি শেষে ঘরে গিয়েও যে ছটফট করে মরি, তাতে কেউ আমাদের সান্ত্বনা দেয় না। যদি কোন ডাক্তার ভুলেও স্মীকার করে বসে, তবে বাকি সবাই তাকে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে আরো দগ্ধ করে মারি। তাকে বলা হয়, “এই প্রফেশন তোমার জন্য না।” প্রিয় কলিগগণ, আসুন আপনাদের একটি তথ্য দেই, রেফারেন্স সহই। ২০১৮ এর মে মাসের ওয়েব মেড এবং ডেইলি মেইলের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী বর্তমানে আমেরিকায় প্রতিদিন অন্তত একজন করে ডাক্তার আত্মহত্যা করে স্ট্রেস সামলাতে না পেরে। মেডিকেল পেশা বর্তমানে পেশার জন্য আত্মহত্যার কারণের মাঝে শীর্ষস্থানে আছে। ২০১৭ সালের মায়ো ক্লিনিকের একটি রিসার্চ অনুযায়ী ডাক্তাররা কখনো তাদের মেন্টাল স্ট্রেসের কথা স্মীকার করেন না পাছে তাদেরকে দুর্বল ভেবে বসে। কি ভয়াবহ কথা! সবার দুঃখের কথা শুনতে বসে আছি, কিন্তু আমার জন্য কেউ নেই।
.
আমরা অনেকে অনেক অধিকার নিয়ে কথা বলি; এর মাঝে মানবাধিকারটাই চাপা পড়ে যায়। ডাক্তারি একটি পেশা বই অন্য কিছু নয়, এই পেশাতে মানুষরাই কাজ করে। সুতরাং অন্যদের যা যা সমস্যা হয় তার প্রত্যেকটিই আমাদের সাথে হতে পারে। নিজেকে মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি দিন, নিজের ভালো লাগা মন্দ লাগাকেও বিবেচনায় আনুন। আজ মন ভালো না লাগলে দুই ঘণ্টার ছুটি নিন, একটা বই এর পাতা উলটাতে। আপনার সহকর্মীর চেহারাটা বিষণ্ণ দেখালে তার হাত ধরে প্রশ্ন করুন, “ঠিক আছো তো?” কেউ পরীক্ষায় পাশ করতে না পারলে তার পাশে গিয়ে ব্যর্থতাকে সফলতায় পালটে দেবার গল্প করে তাকে অনুপ্রাণিত করুন, সে কি আপনার ভাই নয়? আপনার একটি ডিগ্রী বেশি বলে কম ডিগ্রীর সহকর্মীকে চায়ের কাপটি আপনিই এগিয়ে দিন। তাকে বুঝতে সাহায্য করুন যে ডিগ্রী কখনোই সম্মানের সমানুপাতিক নয়, প্রতিটি মানুষ তার নিজ গুণে সম্মানিত। জুনিয়ররা বোকার মত কোন প্রশ্ন করলে খোঁচা না দিয়ে তাদের উত্তরটি কোথায় খুঁজে পেতে হবে বলে দিন। আপনার সিনিয়র ভাই কোন ভুল কথা বললে বন্ধুদের আড্ডায় তাকে তুলোধুনো না করে ভাইকে আড়ালে ডেকে জানিয়ে দিন যে এখনকার গাইডলাইন কি বলছে।
.
আমি যখন প্রথম এখানে চাকরি শুরু করি, তখন আমার পক্ষে সবচেয়ে কঠিন কাজ ছিল সর্বসম্মুখে স্মীকার করা যে আমি এই কাজটি পারিনা। চাকরির প্রথমদিকেই কনসালটেন্টকে এক রুগীকে বলতে শুনলাম, “আমার কোন আইডিয়া নাই তোমার কি হয়েছে। অপেক্ষা করা ছাড়া কোন গতি নাই।” বাইরে বের হয়ে কনসালটেন্টকে ভয়ে ভয়ে বললাম আমার তো সব শুনে সিলিয়াক ডিসিজ মনে হচ্ছে, লেট প্রেজেন্টেশন। কনসালটেন্ট খানিকক্ষণ চিন্তা করে বললেন, “তাই তো। আসলে আমি সিলিয়াক সম্পর্কে তেমন কিছু জানিই না। তা তোমার যেহেতু মনে হচ্ছে, টেস্ট করে জিপির সাথে দেখা করতে বলো।” এবং সে কথাটা বলেছিল কোন দ্বিধা ছাড়া। তৎক্ষণাৎ বুঝলুম পৃথিবীর কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব না সবকিছু জানা, ডাক্তারদের পক্ষে কিভাবে সব জানা সম্ভব? তাহলে কেন একজন ডাক্তার কোন সাধারণ জিনিস না জানলে সবাই মিলে তাকে এভাবে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে? সিলিয়াক ডিজিজ সম্পর্কে না জানাটা অপরাধ না। অপরাধ হচ্ছে অহংবোধে অন্য কারো কথা না শোনার মনমানসিকতা।
.
তের ঘণ্টা ডিউটির এক ভয়াবহ রাতে আমার একবার মনে হয়েছিল আমি পালিয়ে যাবো এবং আর কোনদিনও হাসপাতালে ফিরে যাবো না। এক নার্স কারণ ছাড়াই এক কাপ চা এগিয়ে দিয়ে বলেছিল, “তুমি কি পরিশ্রমটাই না করছো আজ রাতে! আমি কি কোনভাবে সাহায্য করতে পারি?” নিশ্চিত জানি সে আমাকে কোন সাহায্য করতে পারবে না কিন্তু তারপরেও সেটা আমাকে পরের দিন রাতেই আবার আনন্দ নিয়েই কাজে ফেরত যেতে সাহায্য করেছিল। ইট ওয়াজ আ সিম্পল অ্যাক্ট অব কাইন্ডনেস – কিন্তু এক মুহুর্তের জন্য হলেও আমার মনে হয়েছিল অন্তত কেউ একজন বুঝতে পারছে আমার স্ট্রেসটা।
.
এটা এমন কোন কঠিন কাজ নয়। শুধু আপনি নিজেকে এবং আপনার সহকর্মীকে মানুষ হিসেবে ভাববেন, ডাক্তার না। ব্যাস, শুধু এইটুকুই।
Dear Madam
Amazed to read your article and self evaluation. Unfortunately it is a rare syndrome in our Doctor community. Hats off to you!!
May Allah bless you.
Thanks.