আমরা অনেককে দেখি যারা খায় অনেক কিন্তু মোটা হয়না, তাদের শরীর দশ বছর আগেও যেমন দশ বছর পরেও তেমন। আমরা যারা বিজ্ঞানের ছাত্র তারা ভাবি যে এটা হরমোনাল কারণ আর যারা বিজ্ঞানের না তারা ভাবে এদের হজম শক্তি বেশি বলে যা খায় তাই হজম করে নেয়।
হরমোনাল কারণ টা ঠিক অস্বীকার করা যায়না এই ক্ষেত্রে। যাদের হাইপারথাইরয়ডিজম রোগ থাকে মানে থাইরয়েড হরমোন বেশি ক্ষরিত হয় তারাও শুকিয়ে যায়। আর ডায়াবেটিস থাকলে যে শরীরের চর্বি কমে গিয়ে শুকিয়ে যায় এটা প্রায় সবারই জানা।
কিন্তু আমার আজকের কথা হল যাদের এরকম কিছুই নাই কিন্তু তবু খাওয়া নিয়ে চিন্তা করা লাগেনা অর্থাৎ কাজ কম করলেও এদের ওজন বাড়ে না, সবসময় স্লিম থাকে- এদের নিয়ে। ঠিক এদের নিয়ে বললেও ভুল হবে, আসলে এদের উৎপত্তি নিয়ে বলব। তো এদের সাথে শীতকালে গর্ভ ধারণের কী সম্পর্ক? আসুন একটু বুঝে নিই।
এই ব্যাপার নিয়ে বিখ্যাত “Nature” পত্রিকায় এই বছর জুলাই ৯ তারিখ একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে। এই জিনিস বোঝার জন্য আগে কয়েকটা টার্ম বুঝতে হবে। আমি সব স্তরের লোকের বোঝার জন্য যথাসম্ভব সহজ করে বলছি।
চর্বিকে বিজ্ঞানের ভাষায় Adipose tissue বলে। আমাদের শরীরে দুই প্রকারের চর্বি আছে। সাদা আর বাদামী । সাদা কে White Adipose Tissue(WAT) বলে আর বাদামী কে বলে brown adipose tissue (BAT) ।
সাদা চর্বির কাজ হলো খাবার থেকে যে শক্তি তৈরী হয় সেটা দেহের কাজে ব্যবহৃত হবার পরে অতিরিক্তটুকু সঞ্চয় করা আর বাদামীর কাজ ঠিক উল্টা।
এরা খাবারের মাধ্যমে শরীরের প্রয়োজনের তুলনায় বেশি শক্তি আসলে তাকে তাপ বানিয়ে দেয় বা অন্য সময় অতি ঠান্ডায় শরীর কে বাঁচাতে খাবারের ক্যালরী খরচ করে তাপ তৈরি করে। এই চর্বি কোষ গুলো তাদের ভেতরে মাইটোকন্ড্রিয়া তে শক্তি বা ATP তৈরির অক্সিডেটিভ ফসফোরাইলেশন ধাপে ATP তৈরী হতে না দিয়ে ইলেকট্রন চক্রে উদ্ভৃত প্রোটন গুলোকে উল্টো পথে পাঠিয়ে দেয়। ফলে শক্তি তৈরী না হয়ে তাপ তৈরী হয়। এই চক্র ভেঙ্গে দেয়ার কাজ করে একটি প্রোটিন যার নাম Uncoupling protein 1 বা অন্য নামে Thermogenin। এই BAT গুলো থাকে প্রধানত আমাদের গলা,ঘাড় আর বুকের উপরের দিকে।
এখন দেখা যাচ্ছে যে খাবার অতিরিক্ত খেলে সাদা চর্বি বেড়ে যায়, কিন্তু বাদামী চর্বি বাড়া কমা টা খাবারের উপর নির্ভরশীল না বরং এটা জেনেটিক।
আমার আলোচ্য গবেষণা থেকে বিজ্ঞানীরা খেয়াল করেন যে শীতকালে গর্ভধারণ করা ইঁদুরের বাচ্চাদের DNA এর দুইটা অঞ্চল differentially methylated regions (DMRs) ও differentially expressed genes (DEGs) এ কিছু পরিবর্তন হচ্ছে যা সন্তানের শরীরে এই BAT এর পরিমাণ বৃদ্ধি ও এই ফ্যাট গুলোকে অতি সক্রিয় করে তুলছে।
এই ব্যাপার টা মানুষের উপরে পরীক্ষার জন্য তাঁরা ৮৪০০ ছেলে মেয়ে জড়ো করে যাদের অর্ধেকের জন্ম শীতকালে ও অর্ধেকের জন্ম শীতের ৮/৯ মাস পরে। এর অর্থ অর্ধেকের মা গর্ভবতী হয়েছিল শীতের আগে বা গ্রীষ্মকালে আর অর্ধেকের মা হয়েছিল শীতকালে।
বিজ্ঞানীরা অবাক হয়ে খেয়াল করলো যে যাদের মা শীতকালে গর্ভবতী হয়েছে তাদের দেহে এই বাদামী চর্বি অনেক বেশি ও একটিভ। কিন্তু এতে মায়ের ডিম্বাণুর বা দেহের অন্য কোন ভুমিকা না পাওয়াতে বিজ্ঞানীরা পুরুষের শুক্রাণু নিয়ে গবেষণা চালালো। সেখানে দেখা গেলো সরিষা ক্ষেতে ভূত।
বিজ্ঞানীরা বলেন যে অনেকদিন ধরে ঠান্ডা পরিবেশে থাকলে পুরুষের শুক্রাণুর DNA তে epigenetic programming হয়।
এটা আবার কি? এপিজেনেটিক প্রোগ্রামিং মানে হল দেহের ভেতরের বা বাইরের নন জেনেটিক ও পরিবেশগত কারণে আমাদের DNA তে হালকা কিছু সাময়িক পরিবর্তন। তবে স্থায়ী পরিবর্তন কে বলে Mutation যেটা আমাদের জন্য চরম ক্ষতিকর ও হতে পারে। তবে এপিজেনিটিক প্রোগ্রামিং সবসময় ভালো।
এই ঠান্ডা পরিবেশে শুক্রাণুর এপিজেনেটিক পরিবর্তনের কারণে ঐ শুক্রাণুতে উৎপাদিত সন্তানের দেহে বাদামী ফ্যাট বেশি হয় ও একটিভ হয়। তাই এরা পরিণত হলেও অতিরিক্ত খাবারে অতিরিক্ত শক্তিকে এই বাদামী ফ্যাট তাপ বানিয়ে ছেড়ে দেয়। তাই এরা স্লিম থাকে।
এদের পরবর্তী জীবনের চর্বি জনিত কারণে হার্ট ডিজিজেরও সম্ভাবনাও কম অন্যদের চেয়ে।
তবে আমি এটাই বলছিনা যে প্রাকৃতিক বাদামী চর্বি ছাড়া স্লিম হবার উপায় নেই- তা নয়। মুটিয়ে গেলে পরিশ্রম ও ডায়েটের বিকল্প কখনো ছিল না, এখনো নেই।
এখন বলতে পারেন যে, বাইরে থেকে এই চর্বি দেহে ঢুকানো গেলে বা কোন পদ্ধতিতে দেহে বাড়ানো গেলে শীতকালে গর্ভধারণ করে কী লাভ?
এই ক্ষেত্রে দুঃসংবাদ হলো মানুষ এমন কোন ওষুধ বা পদ্ধতি আজো পর্যন্ত আবিষ্কার করেনি যা দিয়ে এই বাদামী চর্বি বাড়ানো যায়।
তাই সুস্থ সবল স্লিম সন্তানের জন্য শীতকালে বিয়ে(গর্ভধারণ) করার বিকল্প নেই- এই কথা স্বীকার না করে উপায় নেই।
নেচার পত্রিকার গবেষণা- https://www.nature.com/articles/s41591-018-0102-y
লেখক:
ডা. আসির মোসাদ্দেক সাকিব
ডেন্টাল সার্জন, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ। সেশন-২০১১-১২