তনিমার খুব মন খারাপ, কিছুতেই ভালো লাগছে না! খুব তুচ্ছ কারনে আজ মামুনের সাথে তুমুল ঝগড়া হয়েছে! ঝগড়া করার সময় ওর মাথা ঠিক কাজ করে না। মুখে কোন কিছুই আটকায় না। ঝগড়ার সময় বলেছে আর কখনোই যেনো মামুন ওর সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা না করে! ফোন ও যেন না দেয়!! দিলে ওর মরা মুখ দেখবে!!!
কি নিয়ে ঝগড়া?
বাসাতে নানা ইস্যু নিয়ে দুজনের মধ্যে লেগেই থাকে! তনিমা একটু খুতখুতে স্বভাবের। কোন কাজই একেবারে পারফেক্ট না হলে মনে শান্তি আসে না! এতে যদি কাজটা ১০ বার ও করা লাগে তাতেও তনিমার কোন ক্লান্তি নাই! দিনকে দিন এই খুত খুতি আর বাড়ছে! আর বিশেষ করে নিজের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে কোন কম্প্রোমাইজ নাই! কোন কিছু করার আগে হাত ধুয়া- হাত পরিষ্কার করা একেবারে ১০০% হতে হবে! রোগ জীবানু কি চোখে দেখা যায়? এই জন্য বার বার হাত ধোয়া লাগে! অনেক সময় পানিতেও ময়লা থাকে! এই জন্য হাত ধোয়া-গোসলে অনেক সময় লাগে। তো আজকে একটা দাওয়াতে যাওয়ার কথা। দুপুরে দাওয়াত! গোসল করে বের হতেই আড়াই ঘন্টা লেগেছে তনিমার! বাথরুম থেকে বের হওয়ার সময় স্যান্ডেল খুলতে গেছে যখন, তখন স্যান্ডেল থেকে পানির ছিটা এসে পায়জামায় লাগছে! ওর মেজাজ টাই খারাপ হয়ে গেলো! প্রথমে ভেবেছে শুধু পায়জামা চেঞ্জ করে ফেলবে! কিন্তু পরে মনের মধ্যে খচ খচ করতে লাগলো! শেষমেস আবার পুরো গোসল করা লাগছে!
এইটাতেই মামুন ক্ষেপে গেছে! মামুন রেডি হয়ে বসে আছে প্রায় দুই ঘন্টা! যাক,তারপরেও যখন বাসা থেকে নেমে নিচ তালায় আসছে,তখন তনিমার মনে হলো আসার সময় দরজাটা লক করে আসা হয় নাই!আবার চার তলা বেয়ে উপরে উঠেছে তনিমা! এসে ৩/৫ বার চেক করে দেখে তালা লাগানো! কিন্তু দরজার কাছে গিয়ে মনে হয়েছে ভিতরে চুলা কি বন্ধ করা হইছে? চুলার গ্যাসের নব খোলা থাকলে তো সর্বনাশ! আবার তালা খুলে, রান্না ঘরে গিয়ে চুলা চেক করে দেখে চুলা বন্ধ! যাক তারপরেও আবার চেক করে, সবগুলো জানালা বন্ধ আছে নাকি দেখে বের হয়ে তালা লাগাচ্ছে যখন,ততক্ষনে মামুন নিচ থেকে ফোন দিচ্ছে, সিএনজি এসে অপেক্ষা করছে। তাড়াহুড়োয় জোড়ে তালা লাগতে গিয়ে চাবি আটকায় গেলো ভিতরে! যখন দেরী হয়, সবদিকে দেরী হয়। এই চাবি খুলতে আরো কতক্ষন! যখন নিচে আসছে তখন মামুন ক্ষেপে বোম হয়ে আছে! কোন কথা না বলে সিএনজিতে গিয়ে বসছে ও!
কিছুক্ষন পর মামুন খেয়াল করলো তনিমা খুব আড়ষ্ট হয়ে সিএনজি তে বসে আছে! কারণ কি জিজ্ঞেস করতেই তনিমা বলে সিনএনজির সিটে নাকি ময়লা আছে! মামুন আর কথা বাড়ায় না! দুপুরের দাওয়াত,তখন সোয়া তিনটা বাজছে! একা একা গজ গজ করতে থাকে মামুন! ‘কোন জায়গায় গিয়ে শান্তি নাই’… তনিমা আসলে বাহিরে গেলে কোথাও খেতে পারে না! আগে যাও টুকটাক পারতো,কিন্তু বিয়ের পর একদমই পারে না! বাহিরের খাবারের কথা চিন্তা করলেই মনে হয়, এই খাবার খেলেই ক্যান্সার হবে! হাজার হাজার – কোটি কোটি রোগ জীবানু কিলবিল করে খাবারের মধ্যে! মামুনের আবার বাহিরের খাবার খুব পছন্দ! কোথাও গিয়ে বসতেও পারে না! বসতেই গেলেই মনে হয়,এই বুঝি ময়লা লেগে গেলো! এ জন্য কোথাও বেড়াতে গেলেও বেশিক্ষন থাকা হয় না
সিএনজি চলছে,হটাৎ তনিমা চিৎকার করে সিএনজি থামাতে বললো! মামুন ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করলো কি হইছে? তনিমা বলে,সামনে ময়লার গাড়ি আছে! ঐ গাড়ি আগে যাক,তারপরে সিএনজি যাবে! সাড়ে তিনটা বাজে! ময়লার গাড়ি যায়না, থেমে ময়লা নামাচ্ছে! এই অবস্থায় পাশ দিয়ে যাওয়া যাবে না! কারণ তাহলে রোগ জীবানু গায়ে পরবে। মামুন তিনবার বললো,সিএনজি পাশ দিয়ে গেলে কিচ্ছু হবে না! কিন্তু তনিমা কিছুতেই যাবে না! একে বারে অবুঝের মতো গো ধরে বসে থাকলো! মামুন যেই বললো, এই সব বারাবাড়ির একটা লিমিট থাকা দরকার! ওমনি তনিমা বার্স্ট করলো! মামুন রেগে সিএনজি থেকে নেমে গেলো, আর তনিমা ৪০ মিনিট অপেক্ষা করে ময়লার গাড়ি যাওয়ার পরে ঐ সিএনজি নিয়ে মা’র বাসায় চলে আসছে!
ইদানীং তনিমা বুঝতে পারে,ওর নিজেরই বাড়াবাড়ি টা বেশি! এতো খুতখুতে হওয়া উচিত না! কিন্তু কোনভাবেই ও এটা থেকে বের হতে পারছে না! যেটা একবার মাথায় ঢুকে ঐটা না করা পর্যন্ত ও শান্তি পায় না! এই কারনে দিনকে দিন সমস্যা বাড়ছে…
কি করবে এখন,তনিমা???
[উপরের ঘটনাটা গল্পনা… আমাদের আশে পাশে এইরকম ‘তনিমা’র দেখা মাঝে মাঝেই পাওয়া যায়। তনিমা একটি বিশেষ মানসিক রোগে ভুগছে। বাংলায় একে শুচিবায়ু /শুচিবাই বলে। আর এই রোগীকে বলে শুচিবাইগ্রস্ত। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় বলে Obsessive Compulsive Disorder বা সংক্ষেপে OCD. শুরুতে এই রোগের লক্ষণ গুলোকে তেমন একটা গুরুত্ব না দিলেও এর প্রকোপ বেড়ে গেলে রোগীর জন্য স্বাভাবিক জীবন যাপন করা অসম্ভব হয়ে উঠে। তনিমার যে লক্ষণ গুলো আছে, সেগুলোর পাশাপাশি অর্থহীন ধর্মীয় চিন্তা, কোন চিন্তা বার বার আসা, টেনশন বেশি হওয়া, কাজের গতি কমে যাওয়া, এক কাজ শেষ করে আরেক কাজে যেতে না পারা, ঘর সংসারের কাজ করতে না পারা, এগুলোও এই রোগের লক্ষণ। এই রোগের একটা ভালো দিক হচ্ছে, নিয়মিত চিকিৎসক এর পরামর্শ মেনে চললে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক লাইফ লীড করা যায়। আর এই রোগের খারাপ দিক হচ্ছে, ভালো হতে বেশ সময় লাগে!
আমাদের জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, শেরে বাংলা নগর, ঢাকাতে প্রতি সপ্তাহের বৃহষ্পতিবার
ওসিডি (OCD) রোগীদের জন্য মাত্র ১০ টাকার বিনিময়ে বিশেষায়িত সেবা প্রদান করা হয় OCD CLINIC এর মাধ্যমে।
ইনস্টিটিউটের পরিচালক ও অধ্যাপক ডা. মো. ফারুক আলম স্যারের প্রত্যক্ষ তত্বাবধানে এই ক্লিনিক পরিচালনা করেন সহকারী অধ্যাপক ডা. ফারজানা রহমান।
আপনার পরিচিত/অপরিচিত কেউ যদি উপরোক্ত সমস্যাগুলোর কোনটিতে ভুগে… পাঠিয়ে দিন আমাদের কাছে…
একজন মানুষের স্বাভাবিক জীবন যাপনে ভুমিকা নিন।]
ডা. মুসতাকিম ফারুকি
রেসিডেন্ট, সাইকিয়াট্রি
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল,
শেরে বাংলা নগর,ঢাকা।