আমরা অনেকেই বলি ডাক্তার হচ্ছে জনগণের ট্যাক্স এর টাকায়। ভাবটা এমন যেন সরকারী মেডিকেল কলেজে যারা পড়ছে কেবল তারাই জনগণের টাকায় পড়ছে। তাই জনগণের টাকার ঋণ পরিশোধের দায়িত্ব কেবলমাত্র ডাক্তারদের।
এমনকি যারা কষ্ট করে টাকা খরচ করে বেসরকারী মেডিকেলে পড়ছে তাদেরও কথা শুনতে হয় এই ট্যাক্স এর টাকা। তারা বলে ডাক্তার তৈরির জন্য জনগণের প্রদত্ত ট্যাক্স এর অনেকটা ব্যয় হচ্ছে। এই কথা গুলো ঠিক না ।
এই অপপ্রচারের সুন্দর একটি জবাব দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের Colorectal সার্জারি বিভাগের সরকারী অধ্যাপক এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজের কে৫০ ব্যাচের প্রাক্তন ছাত্র ডা তানভির জালাল ভাই।
“ডাক্তার তৈরিতে জনগন যে টাকা লগ্নি করছে তার চেয়ে অনেক বেশী প্রতিদান জনগন সরাসরি মেডিকেল কলেজ গুলো থেকে পাচ্ছে। ধরুন সরকার প্রতি বৎসর ঢাকা মেডিকেল এর ব্যয় বাবদ ১০০ কোটি টাকা দিচ্ছে। আসুন দেখি জনগণের ট্যাক্স এর এই ১০০ কোটি টাকা কোথায় খরচ হচ্ছে? এই টাকার ৮০-৯০ শতাংশ টাকা জনগণের জন্যই খরচ হচ্ছে। কিভাবে?
যেসব জনগন ওখানে চিকিৎসা পায় তার ঔষধ,খাবার,পরীক্ষানিরীক্ষা,হাসপাতালের যাবতীয় খরচ(ব্যাড শিট,মশারি, পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা ইত্যাদি ইত্যাদি),হাসপাতালের কর্মকর্তা ও কর্মচারীর বেতন সব কিন্তু জনগণের জন্যই। ছাত্রদের পেছনে খুব সামান্যই ব্যয় হয়। বরাদ্ধের সিংহ ভাগ টাকা তো জনগনই খরচ করলেন। এখন আসুন দেখি এই কলেজ গুলো থেকে জনগন যে সেবা পাচ্ছে তার বাজার মূল্য কতো।
ঢাকা মেডিকেল এর কথাই ধরুন, এখানে প্রতিদিন গড়ে ১০০ টি অপারেশন হয়। প্রতিটি অপারেশন যদি গড়ে ৩০,০০০ টাকা করে ধরেন তাহলে প্রতিদিন ৩০লাখ টাকার অপারেশন হচ্ছে। সেই হিসেবে বৎসরে আসে ১০৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা!এক অপারেশন সেবা দিয়েই মেডিকেল কলেজ গুলো জনগণের প্রদত্ত ট্যাক্স এর টাকার পুরোটাই ফেরৎ দিয়ে দিচ্ছে। বহিবিভাগে রোগী দেখা,জরুরি বিভাগে রোগী দেখা, বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষার রিপোর্ট দেয়া, ভর্তি রোগী দেখা এইসবের চার্জ হিসেব করলে সেটা যে কতো দাঁড়াবে তা আল্লাহই জানেন।
বাস্তবে সরকার/জনগন মাত্র কয়েক কোটি টাকা এইসব মেডিকেল কলেজ এ খরচ করে আর বিনিময়ে শতশত কোটি টাকার সেবা পাচ্ছে। তাহলে বুঝলেন কি “জনগণের ট্যাক্স এর টাকায় ডাক্তার হচ্ছ” কথাটা মোটেও ঠিক না!বরং জনগণকে কোটি কোটি টাকার সেবা দানের মাধ্যমে এক এক জন ডাক্তার তৈরি হচ্ছে।”
হাস্যকর কথা হল,
জনগণের ট্যাক্সের টাকায় অনেকেই পড়ছে।
১। প্রাথমিক স্কুল- ৯৪৮৩৮৯১ জন
২। সেকেন্ডারি স্কুল- ২২১৮৮৭ জন
৩। উচ্চমাধ্যমিক কলেজ- ৩৩৯৬ জন
৪। ডিগ্রি (স্নাতক) কলেজ- ৬৮৪৪২ জন
৫। মাস্টার্স কলেজ- ৩২১৪৭৩ জন
৬। মোট কলেজ শিক্ষা- ৫০৯১৩৭ জন
৭। বিশ্ববিদ্যালয়- ১১৫৯২৯ জন
৮। টেক্সটাইল কলেজ- ৬৪৮ জন
৯। পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট- ১৭৮৩৬ জন
১০। টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজ- ৮৫৪৮ জন
১১। ইন্সটিটিউট অব গ্লাস এন্ড সিরামিক- ১৭৪ জন
১২। ইন্সটিটিউট অব গ্রাফিক্স আর্ট- ২৫৫ জন
১৩। টেক্সটাইল ইন্সটিটিউট- ৮৫৬ জন
১৪। টেক্সটাইল ভোকেশনাল সেন্টার- ৫০৯৭ জন
১৫। টেক্সটাইল ট্রেইনিং সেন্টার- ৪৮৬৭ জন
১৬। সার্ভে ইন্সটিটিউট- ৫৫৭ জন
১৭। কমার্শিয়াল ইন্সটিটিউট- ৩৬৮৩ জন
১৮। এগ্রিকালচারাল ইন্সটিটিউট- ৭১০৩ জন
১৯। মেডিকেল কলেজ- ১১৭৩১ জন
২০। ডেন্টাল কলেজ- ৩৫৮ জন
২১। নার্সিং কলেজ- ২৫২ জন।
২২। হোমিওপ্যাথিক কলেজ- ৫১২ জন
২৩। আয়ুর্বেদিক কলেজ- ৩১৫ জন
২৪। নার্সিং ইন্সটিটিউট- ৫৩৮০ জন
২৫। হেলথ টেকনোলজি- ৩৯৭৩ জন
২৬। লেদার টেকনোলজি- ৪৩৬ জন
http://www.moedu.gov.bd/index.php?option=com_content&task=view&id=300&Itemid=301
এরা সবাই জনগণের ট্যাক্সের টাকায় পড়ে কিন্তু দোষ হয় চিকিৎসকের।
এদের দায়ভারও বহন করতে হয় চিকিৎসকদের।
কি হাস্যকর ব্যাপার।
বিএমএর মহাসচিব ইকবাল আরসালান স্যার একবার বলেছিলেন এই প্রশ্নের জবাবে, “আমি সারা জীবন বলে এসেছি এবং বলবো, চিকিৎসকরা তৈরী হয় বাইপ্রোডাক্ট হিসেবে। দেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্র তার নাগরিকের চিকিৎসা সেবা দিতে বাধ্য। তাই দেশের মানুষকে স্বাস্থসেবা দেয়ার জন্য গড়ে ওঠা বড় বড় সরকারী হাসপাতালগুলোর। সেখানে মানুষের চিকিৎসার জন্য সরকারী নিয়োগপ্রাপ্ত কনসাল্টেন্টসহ অন্যান্য সরকারী ডাক্তাররা। মূলত সেখানে মানুষের চিকিৎসা চলছে…এই process চলাকালীন মেধাবী বাছাই কিছু ছেলে মেয়ে হাতে কলমে শিখে-পড়ে চিকিৎসক হয়ে বের হচ্ছে, এখানে তাকে চিকিৎসক বানানোর পেছনে কোন আলাদা খরচ করা হচ্ছে না, খরচ সরকার করছে মানুষের চিকিৎসার পেছনে, কাজেই সে আপনাদের টাকায় পড়ে চিকিৎসক হয় নি, এটা সেই ছেলে মেয়েটির ক্রেডিট; দুর্বলতা নয়……”
শেষ করছি ডাক্তার নির্ঝর অলয়ের উক্তি দিয়ে, “বাংলাদেশের তরুণ ডাক্তাররা যে সার্ভিস দেয় তা পৃথিবীতে নজিরবিহীন। সারা পৃথিবীতে যদি সপ্তাহে ৫ দিন ৪০ঘণ্টা এবং দ্বিগুণ ওভারটাইমের বিনিময়ে এর বাইরে কাজ করে ডাক্তাররা দ্বিতীয় ঈশ্বরের সম্মান পান তাহলে বাড়তি টাকা ছাড়া সপ্তাহে ৬ দিন কাজ করা আমার দেশের জুনিয়র ডাক্তাররা তার চেয়েও বেশি কিছু! এত বেশি মূল্য দেয়াটা সন্দেহজনক। কারণ এর পেছনে আছে মুষ্টিমেয় লোকের স্বার্থসিদ্ধির গল্প! সপ্তাহে ৬ দিন অফিসের ব্যাপারটি কিন্তু ন্যায্য নয়। এখন আর প্রয়োজনীয়ও নয়। কারণ এখন দেশে পর্যাপ্ত ডাক্তার আছে। কিন্তু তবুও এটা বহাল থাকবে কারণ ৫ দিন করতে গেলে অফিস-টাইম বাড়াতে হবে। নৈতিকভাবে এখন দেশে অন্তত ডাক্তারদের ৬ দিন অফিসের কোন প্রয়োজনীয়তা নেই। সারা বিশ্বে ১৯২৬ সালেই এই প্রথা উঠে গেছে। ট্রেনিং পোস্টগুলোর ব্যাপার আলাদা। তবে সেখানেও কিন্তু যুক্তরাজ্যের ১০০ ঘণ্টার সপ্তাহের কথা কেউ কেউ বলেন। কিন্তু ওই ১০০ ঘণ্টার সপ্তাহের পর যে পুরো সপ্তাহ অফ দেয়া হয়- সেটা এই সুবিধাবাদীরা উদ্দেশ্যমূলকভাবে চেপে যান! নেটে দেখবেন আম্রিকার পুরনো রেসিডেন্সির স্টাইলের পক্ষেও অনেক লোক কথা বলছে। কিন্তু এটা কানার ভাই আন্ধাও বোঝে যে, একটানা ৩০ ঘণ্টা কোন ডাক্তারকে ডিউটি করালে সেটা রোগীর জন্য বিপজ্জনক। তবে সেই ৩০ ঘণ্টার মধ্যে রাত ১২টার পর অন কল আওয়ার থাকে। ডাক্তারের বিশ্রামের জন্য সুশীতল, সুবাসিত রুম থাকে, পড়ার জন্য ইন্টারনেট থাকে, স্পিড 10MBps! কাজেই সেই তুলনায় যাতে সুবিধাবাদীরা না যান! রেসিডেন্সিতে এখন আইন করে একটানা ১৬ ঘণ্টার বেশি এবং সপ্তাহে ৮০ ঘণ্টার বেশি ডিউটি নিষিদ্ধ করা হয়েছে।”
— লেখাটি লিখেছেন ডাক্তার রজত দাশগুপ্ত