সফল যারা কেমন তারা: করোনা মোকাবেলায় সফল দেশগুলির গল্প- প্রসঙ্গ ভিয়েতনাম

প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ০১ মে ২০২০, শুক্রবার:

ডা. আসগর হোসেন

আমেরিকা, ইটালী, বৃটেন ও ফ্রান্সের মতো দেশ যেখানে করোনার তান্ডবে নাস্তানাবুদ সেখানে বেশ কিছু দেশ দেখিয়েছে উল্লেখযোগ্য সাফল্য৷ সেই সব দেশের বিশেষত্ব কি ছিল? ওই সব দেশ থেকে আমাদের কী কিছু শেখার আছে? আসুন দেখে নেই৷ প্রথমেই ঘুরে আসি ভিয়েতনাম৷

পটভূমি:

৭০ এর দশকে শেষ হওয়া, আমেরিকার বিরুদ্ধে চলা ২০ বছরের যুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ থেকে ভিয়েতনামের উত্তরণ ছিল রুপকথার মতো৷ শিক্ষা-গবেষণা, কৃষি ও শিল্পে আজ তারা সারা বিশ্বের অনুকরণীয়৷ আর করোনা মোকাবেলায় তাদের সফলতা কল্পনাকেও হার মানিয়েছে৷ ১০ কোটি লোকের এই তৃতীয় বিশ্বের দেশে এখন পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত মাত্র ২৭০ জন৷ এর মধ্যে ২২৪ জন সম্পুর্ণ সুস্থ হয়েছেন৷ করোনায় মৃত্যু সংখ্যা শুণ্য৷ এ পর্যন্ত সেখানে প্রায় আড়াই লক্ষ লোকের ‘করোনা টেস্ট’ করা হয়েছে এবং তা সম্পন্ন করা হয়েছে তাদের নিজস্ব ‘টেস্ট-কিট’ দিয়েই৷ এই আড়াই লক্ষ পরীক্ষার মধ্যে প্রতি ৭৯১ জনে মাত্র একজন পজিটিভ পাওয়া গিয়েছে যা কিনা সারা পৃথিবীতে বিরল একটা দৃষ্টান্ত৷ এখন সারা পৃথিবীর দৃষ্টি ভিয়েতনামের দিকে- তারা জানতে চাচ্ছে কি করে এই অসম্ভব কে সম্ভব করা হয়েছে৷

ভিয়েতনামের গৃহীত ব্যবস্থা :

১. জানুয়ারীর মাঝামাঝি ভিয়েতনামে সর্বপ্রথম ২ জন করোনা রোগী ধরা পড়ে৷ এরপর ২৩ শে জানুয়ারী তারিখে চিনের উহান থেকে আসা সমস্ত ফ্লাইট বন্ধ করে দেয়া হয়৷ চিনের সাথে ১৪০০ কি.মি. স্থল বর্ডার বন্ধ করে দেয়া হয়৷ এই সময়ে করোনা প্রতিরোধকল্পে বিশদ কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় এবং ২২শে জানুয়ারী থেকে ২ রা ফেব্রয়ারীর মধ্যে সেই কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী সমস্ত প্রস্তুতি শেষ হয়৷

গৃহীত কর্মপরিকল্পনার অনুষদগুলি ছিল:

ক) করোনা প্রতিরোধে ডাক্তার ও জনগনের জন্য বিস্তারিত গাইডলাইন/নির্দেশনা প্রণয়ন।

খ) Mass testing for Early Detection of Cases.

গ) Strict Isolation and treatment of the cases.

ঘ) সমগ্র দেশের জেলা গুলিকে উচ্চ-ঝুঁকি, মধ্যম-ঝুঁকি ও নিম্ন-ঝুঁকি এই তিন ভাবে চিহ্নিত করে প্রতি এলাকার জন্য উপযোগী ভিন্নমাত্রার সাবধানতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ ৷

ঙ) Mobilisation of National Resources for Extinguishing the Corona Pandemic.

২. জাতিগতভাবে ভিয়েতনামীরা সু-শৃংখল ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল৷ এছাড়া তারা পরিস্কার পরিচ্ছন্নতাবোধ সম্পন্ন৷ এতদসত্বেও পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে অধিকতর সতর্কতা জারি করা হয়৷ রাস্তায় থুথু ফেলা শাস্তিযোগ্য অপরাধ বিবেচিত হয়৷ সমস্ত হ্যানয় শহরকে এ্যান্টিসেপটিক দিয়ে নিয়মিত পরিস্কার করা হয় ও পাবলিক ট্রান্সপোর্ট সহ বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে জীবানুনাশক ছিটানো হয়৷ জনগন সরকারের নির্দেশ মেনে চলে ও দায়িত্ববোধের পরিচয় দেয়৷

৩. Social Distancing সহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় সরকারী নির্দেশনা প্রতিদিন Message আকারে মোবাইলের মাধ্যমে জনগনকে জানানো হয়৷ Social Distancing কার্যক্রমের অংশ হিসাবে Vending Machine এর সাহায্যে জনগনের জন্য চাউল সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়৷

৪. আগেভাগেই দেশীয় গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীতে ব্যাপকভাবে মাস্ক ও PPE উৎপাদন করা হয়৷ তার পরিমাণ এত বেশী ছিল যে, যেখানে পৃথিবীর প্রতিটি দেশে মাস্ক ও PPE সংকটে ছিল সেখানে তারা নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানী করে৷

৫. ভিয়েতনাম মিলিটারী মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটি নিজস্ব প্রযুক্তিতে টেস্ট কিট উদ্ভাবন করে যা এক ঘন্টায় রিপোর্ট দিতে সক্ষম৷ সরকার দ্রুততম সময়ে সেই কিটের লাইসেন্স প্রদান করে ও ব্যাপক ভাবে সারা দেশে এই কিট দিয়ে পরীক্ষা করা হয়৷ মার্চ নাগাদ সারা দেশে ১২২ টি কেন্দ্রে বিনামুল্যে পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয় ৷ এখন এই কিট তারা বানিজ্যিকভাবে উৎপাদন করে বিদেশে রপ্তানী করছে ৷

৬. সারা দেশে করোনা চিকিৎসা ফ্রি করে দেয়া হয়৷

৭. সমস্ত হোটেলে বা অফিসে ঢোকার সময় বা পাবলিক ট্রান্সপোর্টে চলাচলের সময় করোনা পরীক্ষা রিপোর্ট দেখানো বাধ্যতামুলক করা হয়৷

৮. করোনা চিকিৎসার জন্য বিশেষ হাসপাতাল ২২ জানুয়ারী থেকে ২ ফেব্রুয়ারীর মধ্যে প্রস্তুত করা হয়৷ এই সমস্ত হাসপাতালে পর্যাপ্ত পরিমান ICU বেড ও ভেন্টিলেটর প্রস্তুত রাখা হয়৷

৯. কোন ভাবেই যেন বিদেশ থেকে আসা করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি শহরে বা দেশে ছড়িয়ে পড়তে না পারে এ লক্ষ্যে হ্যানয় এয়ারপোর্টের ভিতরেই ২রা ফেব্রুয়ারীর মধ্যে কোয়ারান্টাইন সেন্টার স্থাপন করা হয়৷ সেখানে প্রায় এক লক্ষ লোককে কোয়ারান্টাইনে রাখা হয়৷ কোয়ারান্টাইনে থাকা লোকদেরকে প্রয়োজনে ৩ বার পর্যন্ত পরীক্ষা করে বিপদমুক্ত কিনা তা নিশ্চিত করা হয়৷ যত উঁচু পর্যায়ের কর্মকর্তা হোন না কেন – এই কোয়ারান্টাইন থেকে কারোর মুক্তি ছিলনা৷ মিলিটারী এই কোয়ারান্টাইন সেন্টার পরিচালনার দায়ীত্ব পায়৷

১০. পর্যাপ্ত ডাক্তার নার্স সমন্বয়ে প্রশিক্ষিত মেডিক্যাল টিম প্রস্তুত করা হয়৷ প্রত্যেক স্বাস্থ্য কর্মীর জন্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তা সরঞ্জাম প্রস্তুত রাখা হয় এবং ১ দিন পর পর প্রত্যেক স্বাস্থ্যকর্মীর জন্য করোনার পরীক্ষা বাধ্যতামুলক করা হয়৷

১১. সমস্ত কার্যক্রম নিয়মিতভাবে তদারকি ও পর্যালোচনা (Audit) করা হয়৷ জনগনের মতামত নেয়া হয় ও তাদেরকে সম্পৃক্ত করা হয়৷

উপসংহার:

করোনা মোকাবেলায় ভিয়েতনাম সরকার জনগনও দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা ও দায়িত্ববোধ (Commitment and Dedication) এর চূড়ান্ত এক নমুনা দেখিয়েছেন৷ প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রত্যেকে আন্তরিকতার সাথে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করেছেন৷ আর জনগনও সরকারের সদিচ্ছার প্রতি আস্থাবান হবার কারণেই যথেষ্ট দায়ীত্ববোধের পরিচয় দিয়েছেন৷

সময়োপযোগী পরিকল্পনা ও কার্যক্রম গ্রহণ ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিভাগের জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ ও তাদের মধ্যে যথাযথ সমন্বয় সাধনই ছিল ভিয়েতনাম সরকারের সফলতার মূলমন্ত্র৷

ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের ভাষ্যমতে, সফলভাবে করোনা সংকট মোকাবেলা করার কারণে, করোনা উত্তর পৃথিবীর অর্থনৈতিক মন্দার আঘাত ভিয়েতনামে তত বেশী অনুভুত হবেনা৷ ভিয়েতনামের দৃষ্টান্ত থেকে সারা পৃথিবীর অনেক কিছু শেখার আছে৷

Abdullah Al Maruf

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

করোনার দিনগুলি - ৫

Sat May 2 , 2020
২ মে ২০২০, শনিবার জীবন যেখানে থমকে গেছে, সময় যেখানে ঘড়ির কাটায় সীমাবদ্ধ, মানুষ যেখানে চার দেয়ালে বন্দি, ঠিক সেই সময়ে কিছু মানুষ ব্যস্ত সময় পার করছে নতুন জীবন কে স্বাগত জানাতে! কিছু মানুষের যন্ত্রণা ভোলাতে! যে সুপার কিউট বাচ্চাটা দেখছেন, এই বাচ্চাটা আজ আমাদের হাসপাতালে ভূমিষ্ট হওয়ার মধ্যদিয়ে যুদ্ধরত […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo