৮ টা মিস কল; ৯ম বার বাজছে। ঘুম জড়িত কণ্ঠে সালাম দেওয়ার সাথে সাথে ওপাশ থেকে এক মহিলার হাউমাউ কান্না। সাথে সাথে ঘুম উড়ে গেল।
“স্যার আমাকে বাঁচান, প্লিজ আমাকে বাঁচান। আমার দুইটা সন্তান। ওদের কি হবে?”
মহিলা আমার পুরাতন রুগী। “আরে কি হইসে, আগে থামেন”।
সারমর্ম হল তার তীব্র ডায়েরিয়া। টয়লেট থেকেই বের হতে পারছে না। ভর্তি হওয়ার কথা বলে, চিকিৎসা-পরামর্শ দিয়ে ফোন রাখার সময় সেই কান্না আবার, “স্যার ফোন ধইরেন। আমাকে বাঁচান, আমার দুইটা…………”
দুই দিন পরে মহিলা এলেন। হাসি দিয়ে বললেন, “ইস এত রাতে আপনাকে না পেলে যে আমার কি হত………!”
… … …
ইন্টার্নীর সময় এক রুগীর স্ত্রী একদিন ডেকে আমার হাতে দুটা বড় বড় ফজলি আম ধরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, “আপনি অনেক কষ্ট করেছেন। আমার দেওয়ার মত তেমন কিছু নেই। আম দুটা রাখেন প্লিজ”।
আম দেখে বন্ধুরা অনেক হাসাহাসি করল। আমি কিন্তু সেটার ছবি তুলে রেখে দিলাম।
“There is a story behind every picture.”
… … …
আপনি ডাক্তার হয়ে থাকলে এই দৃশ্যগুলো কথাগুলো কোনদিন ভুলে যেতে চাইবেন না। ফার্স্ট ইয়ারের আন্ডা বাচ্চারা আইটেম থেকে শুরু করে মিড লেভেল ডিগ্রী আর প্রফেসর সাহেবের চেম্বারের সামনের কম ভিড়, সবাই কম বেশি হতাশ। ডাক্তার অথচ হতাশ নেই আমি কখনও দেখিনি।
কিছু মানুষ বসে থাকে শুধু এই রকম কিছু দৃশ্যের জন্য। রুগীর গালি খায়, কখনও মারও খায়, তবুও মাথা গুজে পড়ে থাকে। আমাদের রাতগুলো হারিয়ে যায় ব্যস্ততায়, ইমার্জেন্সির চেয়ারে। সময়গুলো পচে যায় নাইট ডিউটিতে, রুগীর গালিতে।
ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফারেরা একটা ভাল দৃশ্যের জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা ক্যামেরার লেন্সে চোখ রাখে, উঁচু টিলার আড়ালে কনুয়ে ভর দিয়ে শুয়ে থাকে। পিপড়ার কামড়, মশার চুলকানি নীরবে মেনে নেয়।
চিকিৎসকেরা তার থেকেও বেশি কিছু। অনেকে পরিবার থেকে আলাদা, প্রিয় মানুষটি থেকে আলাদা, শৈশব-কৈশরের স্মৃতিগুলো থেকে বহু দূরে।
… … …
ঈদের দিন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মূল ফটকে তালা ঝুলবে। পাঞ্জাবি পরে শাড়ী পরিহিতার হাত ধরে টিএসসিতে যাবে অনেকে। জীবনে রঙের শেষ নেই। এ রঙে ভালবাসা আছে, খুনসুটি আছে ফুসকা আছে, আইসক্রিম আছে, হুডতোলা রিক্সাও আছে।
জীবনে উৎসব আসে, সেই উৎসবে আলোর ফোয়ারা ছুটে। আমরা আলো খুজি অপারেশন থিয়েটারের আলোর বিবর্ন ফোকাসে। উৎসবে আমরা হাসপাতালে তালা মারতে পারি না। কিছু ডাকাত রাত জেগে বসে থাকে। এদের চোখে কোন রং থাকে না। এদের উৎসব নেই, এদের প্রিয় কেউ নেই; এরা বর্ণান্ধ।
… … …
কসাইদের আসলে ঈদ নেই। এক ডাক্তার আপু আর ভাইয়া দুই জনেই ঈদের দিনে ডিউটিতে। ভাইয়া ওটিতে আর আপু রাউন্ডে। ৫ বছরের ছেলেটা একবার এই ফ্লোর বাবার কাছে আরেকবার ওই ফ্লোরে মায়ের ছুটাছুটি করছে।
এক রুগীর মা ছেলেটাকে নাস্তা দিয়ে জিজ্ঞেস করল, “আম্মু কি রান্না করেছে?”
ছেলেটা জবাব না দিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিল। আমি নীরবে নিভ্রিতিতে দেখে যাচ্ছিলাম। এখানে দূভার্গ্যটা যে কার, আমি নিজেও জানি না।
নাহ, এই পেশায় হতাশার হওয়ার কিছু নেই। অপেক্ষা করে থাকি ওই কথা আর দৃশ্যটার জন্য। কেউ এসে বলবে, ‘আপনি না থাকলে যে কি হত………?
“আল্লাহ হয়ত আমাকে এই দিনের জন্যই সৃষ্টি করেছেন। এটাই আমার ঈদ”
“সবাইকে ঈদ মোবারক”
লিখেছেন:
ডা. কামরুজ্জামান চৌধুরী
উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল