সরকারিভাবে নিয়োগবঞ্চিত ডেন্টাল সার্জনরা

রবিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৫

প্রতিবছর যে হারে ডেন্টাল সার্জন পাস করে বের হচ্ছেন, তার বিপরীতে সরকারিভাবে তাঁদের নিয়োগের হার কম। বিসিএসের মাধ্যমেও সহকারী সার্জনের পাশাপাশি ডেন্টাল সার্জন কম নিয়োগ হচ্ছে। এতে ডেন্টাল সার্জনদের বড় একটি অংশ সরকারি চাকরি পাচ্ছেন না। বাধ্য হয়ে বেসরকারি চাকরি বা ব্যক্তিগতভাবে চেম্বার খুলে চিকিৎসা করছেন। তাই সরকারিভাবে ও বিসিএসের মাধ্যমে ডেন্টাল সার্জনদের নিয়োগ বাড়ানোর আবেদন করেছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। সম্প্রতি প্রথম আলোর বরাতে মিলেছে এমন তথ্য।

গত কয়েক বছরের কয়েকটি বিসিএস পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ৩১ থেকে ৩৯তম বিসিএসে ক্যাডার হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন ৬৯০ ডেন্টাল সার্জন আর বিসিএসে পাস করে অপেক্ষমাণ নন–ক্যাডার থেকে নিয়োগের অপেক্ষায় থেকেও নিয়োগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন ৪৪৯ ডেন্টাল সার্জন। অথচ এ সময় ক্যাডার হিসেবে সহকারী সার্জন নিয়োগ পেয়েছেন ১৪ হাজার ৮৬৮ জন। পাশাপাশি নন–ক্যাডার থেকেও বেশ কিছু সহকারী সার্জন নিয়োগ পেয়েছেন। হিসাব বলছে, সহকারী সার্জন যেভাবে নেওয়া হয়েছে, সেই অনুপাতে ডেন্টাল সার্জন নিয়োগ হয়েছে কম।

৩৯তম বিসিএসে দুই ধাপে সাড়ে ৬ হাজার চিকিৎসক নিলেও সেই অনুপাতে ডেন্টাল সার্জনদের নিয়োগ দেওয়া হয়নি। ৪২তম বিসিএসে ৪ হাজার চিকিৎসক নিলেও (ভাইভা চলছে) ডেন্টাল সার্জনদের সেখানে শূন্য পদ রাখা হয়েছে। অথচ এটা চিকিৎসকদের বিশেষ বিসিএস। ২০১৭ সালে প্রধানমন্ত্রী স্বাক্ষরিত চিকিৎসকদের নিয়োগের ব্যাপারে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছিল, যেখানে ১০ হাজার চিকিৎসক নেওয়ার কথা ছিল। এর মধ্যে ৯ হাজার ৫০০ সহকারী সার্জন ও ৫০০ ডেন্টাল সার্জন নেওয়ার কথা ছিল। এরই মধ্যে ৩৯তম বিসিএস থেকে সাড়ে ৬ হাজার এবং ৪২তম বিসিএস থেকে ৪ হাজার চিকিৎসকের নিয়োগ হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু ৫০০ ডেন্টাল সার্জন নিয়োগের বিষয়টির কোনো সুরাহা হয়নি।

চলমান ৪০ ও ৪২তম বিসিএস থেকে কোনো ডেন্টাল সার্জন নিয়োগ দেওয়া হয়নি। যদিও ৪২তম বিসিএস চিকিৎসক নিয়োগের বিশেষ বিসিএস। শুধু ৪১তম বিসিএস থেকে ৩০ ডেন্টাল সার্জন নেওয়ার কথা রয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিবছর সরকারের ৩টি ডেন্টাল কলেজ থেকে ৩৩০ এবং ৬টি ডেন্টাল ইউনিট থেকে ৩২৫ ডেন্টাল সার্জন পাস করে বের হন। ১৩টি বেসরকারি ডেন্টাল থেকে আনুমানিক ১ হাজার ৬০০ ডেন্টাল সার্জন বের হন। প্রতিবছর মোট ২ হাজার ২৫৫ ডেন্টাল সার্জন পাস করে বের হন। তাঁদের বেশির ভাগই সরকারি চাকরির আশায় থাকেন। তা না পেয়ে বেসরকারিভাবে কাজ শুরু করেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নথি বলছে, প্রায় ১৭ কোটি লোকসংখ্যার এ দেশে সব পর্যায়ে সরকারি ডেন্টাল সার্জনের সংখ্যা মাত্র ১ হাজার ২৯৬, যা এই বিশাল জনসংখ্যার তুলনায় খুবই নগণ্য। আর এর সিংহভাগই ঢাকা ডেন্টাল কলেজসহ বিভিন্ন টারশিয়ারি লেভেল হাসপাতালে কর্মরত। ৬ থেকে ১৬.৫ লাখ জনসংখ্যার একটি উপজেলার জনগণের জন্য একটিমাত্র ডেন্টাল সার্জনের পদ, অথচ সেখানে এমবিবিএস চিকিৎসকের পদ রয়েছে ২১টি। এমনকি ১০০ শয্যা ও ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালেও ডেন্টাল সার্জনের সৃজনকৃত পদ রয়েছে মাত্র একটি করে।

দেশের ক্রমবর্ধমান দাঁত ও মুখের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতকল্পে বিভিন্ন হাসপাতালে ডেন্টাল সার্জনের পদ সৃজন দেশের সার্বিক স্বাস্থ্যের মানোন্নয়নে বিশেষ জরুরি।

কয়েক ডেন্টাল সার্জন জানান, বর্তমান পরিস্থিতিতে উপজেলা হাসপাতালসহ সব সরকারি হাসপাতালে কর্মরত ডেন্টাল সার্জনরা এই করোনা মহামারিতেও জনগণকে জরুরি দন্ত ও মুখগহ্বরের রোগের চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছেন এবং করোনা আইসোলেশন ওয়ার্ডেও দায়িত্ব পালন করছেন। এরই মধ্যে উপজেলার করোনায় আক্রান্ত শতাধিক ডেন্টাল সার্জন আইসোলেশনে, হোম বা প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে চিকিৎসাধীন এবং কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছে। এক দিকে ডেন্টাল সার্জনের স্বল্পতা, অন্যদিকে অসুস্থতার কারণে কেউ কেউ ছুটিতে থাকায় হাসপাতালে দন্ত চিকিৎসাসেবা মারাত্মক ব্যাহত হচ্ছে। দন্ত চিকিৎসাসেবা যাতে ভেঙে না পড়ে, এ জন্য সহকারী ডেন্টাল সার্জন নিয়োগের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে জরুরিভাবে ৩০০ সহকারী ডেন্টাল সার্জন নিয়োগের যৌক্তিকতা তুলে ধরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে গত বছরের ১৭ মে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে একটি প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।

দেশের একটি উপজেলায় একটিমাত্র ৫০ শয্যার (শয্যা কমবেশি হতে পারে) উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স (উপজেলা হাসপাতাল) আছে। এসব হাসপাতালে ডেন্টাল সার্জনের একটিমাত্র পদ আছে। বর্তমানে অনেক উপজেলায় ডেন্টাল সার্জনের পদ শূন্য আছে। আবার যেখানে ডেন্টাল সার্জন আছেন, সেখানেও কোনো কারণে ডেন্টাল সার্জন ছুটিতে থাকলে বা অসুস্থ হলে মাসের পর মাস ওই হাসপাতালে দন্ত ও মুখগহ্বরের চিকিৎসাসেবা বন্ধ থাকে। এতে দেশের জনগণের দন্ত চিকিৎসাসেবাসহ জরুরি মুখগহ্বরের চিকিৎসা মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। অন্যদিকে মানসম্পন্ন দন্তসেবার অভাবে গ্রামাঞ্চলে হাতুড়ে চিকিৎসার দুর্ভাগ্যজনক ব্যবসা চলছে। এসব হাতুড়ে চিকিৎসক অশিক্ষিত, অপটু এবং তাঁদের পেশাগত কোনো জ্ঞান নেই। ওষুধ ব্যবহারের ব্যাপারে এবং ১৯৮০ সালে প্রচলিত চিকিৎসা ও দন্ত চিকিৎসাবিধি সম্পর্কেও তাঁরা অজ্ঞ। ফলে প্রান্তিক পর্যায়ে রেজিস্টার্ড ডেন্টাল সার্জনের অভাবে অদক্ষ বা কোয়াক দন্ত চিকিৎসকের কাছে চিকিৎসা নিয়ে বহুসংখ্যক রোগী দুরারোগ্য মুখের ক্যানসার, রক্তবাহিত হেপাটাইটিস-বি/সিসহ নানা ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত জটিল ও কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে ধুঁকে ধুঁকে মরছেন। এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বিশ্বে ক্যানসারের ৬ষ্ঠ স্থানে রয়েছে মুখের ক্যানসার।

প্রথম আলোর বরাতে জানা যায়, এ বিষয়ে ঢাকা ডেন্টাল কলেজের অধ্যক্ষ ও বাংলাদেশ ডেন্টাল সোসাইটির মহাসচিব হুমায়ুন বুলবুল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা আশা করেছিলাম, বিসিএসে দুই হাজার চিকিৎসকের পাশাপাশি সহকারী ডেন্টাল সার্জনও নিয়োগ পাবেন। কিন্তু এ নিয়োগে ডেন্টাল সার্জন না থাকায় অবাক হয়েছি। এতে এ ধরনের চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হতে পারে।’ তিনি জরুরি ভিত্তিতে ডেন্টাল সার্জন নিয়োগের জন্য স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা ডেন্টাল সার্জনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি। এ জন্য ডেন্টাল সার্জন নিয়োগের তাগিদপত্র অনুমোদনক্রমে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে দেওয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, বিসিএসে যেন বেশিসংখ্যক সহকারী ডেন্টাল সার্জন নিয়োগ দেওয়া হয়। এ লক্ষ্যে আমরা প্রয়োজনীয় তথ্য–উপাত্তসহ কাগজ জমা দিয়েছি। আশা করি, শিগগিরই এ নিয়োগের ব্যবস্থা হবে।’

এ বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য জানতে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলে তারা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।

প্ল্যাটফর্ম কনট্রিবিউটর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

দালালচক্রে হাতে জিম্মি রোগী ও চিকিৎসক ; ভালো ওষুধ লিখলেই দেয়া হয় হুমকি

Sun Apr 27 , 2025
রবিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৫ পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চলছে ওষুধ কোম্পানির দালালদের দৌরাত্ম্য। সম্পূর্ণ চিকিৎসাসেবা হয়ে উঠেছে দালালনির্ভর। হাসপাতালের ভেতরে সক্রিয় একটি ওষুধ কোম্পানির দালাল চক্রের হাতে রোগীদের পাশাপাশি জিম্মি হয়ে আছেন চিকিৎসকরা। স্বাধীনভাবে ভালো ও মানসম্পন্ন ওষুধ লিখতে পারছেন না। এতে সাধারণ রোগীরা যেমন মানসম্পন্ন চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo