বুধবার, ২৭ নভেম্বর, ২০২৪
গত বছরখানেক ধরে সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির (ইপিআই) টিকা সরবরাহ বন্ধ থাকায় সময়মতো টিকা দেওয়া যাচ্ছে না লক্ষাধিক নবজাতক শিশুকে, স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে ভুগছে তারা। ইপিআই’র আওতায় দেশে জন্মের পর থেকে দেড় মাস বয়সী শিশুদের বিভিন্ন রোগের প্রতিষেধক টিকা দেওয়া হয়। তবে বছরখানেক ধরে প্রতিষেধক পেন্টাভ্যালেন্ট ও পিসিভি টিকার সরবরাহ পর্যাপ্ত না থাকায় সময়মতো টিকা পাচ্ছে না অনেক শিশু। বেশিরভাগ সরকারি হাসপাতালসহ বিভিন্ন টিকাদানকেন্দ্রে গিয়ে টিকা না পেয়ে এসব শিশুর হতাশ মা ও স্বজনরা বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন। শিশুকে সময়মতো টিকা দিতে না পেরে এ নিয়ে উদ্বিগ্ন অভিভাবকরা।
দেশের বেশিরভাগ বিভাগীয়, জেলা শহর ও উপজেলায় এই চিত্র বিরাজমান। এর মধ্যে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, মুন্সিগঞ্জ, নওগাঁ, ভোলা, নোয়াখালী, চাঁদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, রংপুর, রাজশাহী থেকে এ সংকটের বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে। তবে অনেক জায়গায় সংকটের দরুণ তৎপর হয়েছে দালালচক্র। টাকার বিনিময়ে আশেপাশের টিকাদানকেন্দ্র থেকে এনে সরকারি এসব টিকা অবৈধভাবে বিক্রি করছে চক্রটি। টিকার সংকটের বিষয়ে জাতীয় গণমাধ্যমে একাধিকবার প্রতিবেদন করা হলেও মেলেনি প্রতিকার!
টিকার সংকটের বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা প্ল্যাটফর্মকে বলেন, “সারা দেশে এসব টিকার সংকট দেখা দিয়েছে। মহাখালী থেকে এগুলো সরবরাহ করা হয়। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে চাহিদার কথা জানান হচ্ছে। কিন্তু সরবরাহ বন্ধ আছে। সরবরাহ পেলেই সংকট কেটে যাবে। টিকা আসার পর শিশুদের এক বছরের মধ্যেও দিতে পারলে কোনও সমস্যা হবে না। যদি তারও বেশি সময় লাগে তখন স্বাস্থ্যঝুঁকি থাকবে। তবে অচিরেই সব টিকা পাবো বলে আশা করছি আমরা।”
ইপিআইয়ের সাম্প্রতিক তথ্য অনুসারে গত অক্টোবর পর্যন্ত টিকায় বাজেট বরাদ্দ থাকলেও বিশেষ কিছু অ্যান্টিজেন যেমন পিসিভি, ওপিভি এবং এমআর টিকার সংকট সৃষ্টি হয়েছে অক্টোবর মাসের বহু আগেই। এছাড়া বিসিজি ও ওপিভি টিকা নভেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত, টিডি ও পেনটা টিকা ডিসেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত, আইপিভি টিকা জানুয়ারি ২০২৫ পর্যন্ত এবং পিসিভি টিকা মার্চ ২০২৫ পর্যন্ত বরাদ্দ আছে। কিন্তু তথ্যগুলোকে ভুল প্রমাণ করে কেন টিকার সংকট দেখা দিল, সে বিষয়ে জানতে ইপিআই প্রোগ্রাম ম্যানেজারকে ফোন দিলে তার মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যায়!
উল্লেখ্য যে ১৯৭৪ সালের মাঝামাঝি থেকে বিশ্বের প্রতিটি শিশুর জন্য টিকা নিশ্চিত করার লক্ষ্যকে সামনে রেখে ইপিআইয়ের কার্যক্রম শুরু হয়েছিল এবং ১৯৭৯ সালের ৭ এপ্রিল বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসে বাংলাদেশে ইপিআই কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে। পরে ১৯৮৫ সালে ইপিআই কার্যক্রম সারা দেশে সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেওয়া হয় এবং জাতিসংঘের কাছে ১৯৯০ সালে বাংলাদেশের প্রতিটি শিশুর জন্য টিকা নিশ্চিতকরণে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা হয়। সাফল্যের ধারাবাহিকতায় গত ৪৫ বছরে বাংলাদেশ টিকাদান কার্যক্রমে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করে।
ইপিআই কাভারেজ ইভাল্যুয়েশন সার্ভে ২০১৯–এর পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায় বাংলাদেশে ১৯৮৪ সালে সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির কভারেজ ছিল ২ শতাংশের নিচে, যা বর্তমানে ৮৩.৯ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। ইপিআই, ডিজিএইচএস, কাভারেজ ইভাল্যুয়েশন সার্ভে ২০১৯, রিপোর্ট ডিসেম্বর ২০২০ থেকে দেখা গেছে– ২০১০ সালে কর্মসূচির কাভারেজ ছিল ৭৯.৪ শতাংশ, যা ২০১৯ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৮৩.৯ শতাংশ, অগ্রগতি মাত্র ৪.৫ শতাংশ। উল্লেখ্য, গত ১২ বছরে ইপিআই কাভারেজ ৮৪%–এর নিচে অবস্থান করছে এবং ১৬% শিশু টিকা সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
পরিসংখ্যান বলছে বর্তমানে বাংলাদেশে ১,৩৪,০০০টি আউটরিচ সেন্টারে টিকাদান কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। এসব টিকাকেন্দ্র সরকারি, বেসরকারি এবং উন্নয়ন সহযোগীদের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। ইপিআই কর্মসূচি প্রবর্তনের আগে বাংলাদেশে ছয়টি প্রধান প্রাণঘাতী রোগে প্রতিবছর প্রায় ২৫ লাখ শিশু মারা যেত; কিন্তু বর্তমানে সেই মৃত্যুহার কমেছে ৮১.৫ শতাংশ।
বাংলাদেশে ইপিআইয়ের আওতায় ১০টি টিকা বিনা মূল্যে দেওয়া হয়, যেমন যক্ষ্মা (টিবি), ডিফথেরিয়া, হুপিংকাশি (পারটুসিস), ধনুষ্টংকার (টিটেনাস), হেপাটাইটিস বি, হেমোফিলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা বি, নিউমোকক্কাল নিউমোনিয়া, পোলিও, হাম ও রুবেলা। ইপিআইয়ের জন্মলগ্নে ৬টি টিকার মধ্য দিয়ে কার্যক্রম শুরু হলে ও গত কয়েক বছরে ভ্যাকসিন শিডিউলে আরও বেশ কিছু নতুন টিকা যোগ করা হয়েছে, ২০০৩ সালে হেপাটাইটিস বি, ২০০৯ সালে এইচআইবি, ২০১২ সালে রুবেলা ২০১৫ সালে পিসিভি এবং আইপিভি, এমআর দ্বিতীয় ডোজ ২০১৫ সালে এবং ২০১৭ সালে এফআইপিভি উল্লেখযোগ্য।
সম্প্রতি ২০১৬ সালে এইচপিভি ভ্যাকসিনের পাইলট প্রকল্প হাতে নেওয়া হয় এবং ২ অক্টোবর ২০২৩ সালে সফলভাবে এইচপিভি ভ্যাকসিন বাংলাদেশে চালু করা হয়েছে, যা মেয়েদের জরায়ু ক্যানসার প্রতিরোধে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। ২০২৩ সালে এইচপিভি টিকাদান ঢাকা বিভাগে সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে এবং ২০২৪ সালের মধ্যে সারা দেশে একযোগে টিকাদান ক্যাম্পেইন পরিচালনা করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এরপর এইচপিভি ভ্যাকসিনকে ২০২৫ সাল থেকে ইপিআই শিডিউলের আওতাভুক্ত করা হবে। বাংলাদেশ সরকার ইতিমধ্যে ইপিআই শিডিউলে আরও বেশ কয়েকটি নতুন টিকা যুক্ত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। তার মধ্যে ডায়রিয়া নির্মূলে রোটাভাইরাসের টিকা, মস্তিষ্ক প্রদাহজনিত হলুদ জ্বর ঠেকাতে জাপানি এনসেফেলাইটিস টিকা এবং পানিবাহিত রোগ টাইফয়েড ঠেকাতে টাইফয়েড কনজুগেট টিকা (টিসিভি) উল্লেখযোগ্য।
উদ্বেগের বিষয় হল আগামী ২০২৯ সালের পর দ্যা ভ্যাকসিন এলায়েন্স (GAVI) এর টিকাদান প্রকল্পে সহায়তা বন্ধ হয়ে গেলে সরকারকে নিজস্ব অর্থায়নে টিকাদান কর্মসূচি পরিচালনা করতে হবে।
প্ল্যাটফর্ম প্রতিবেদকঃ মঈন উদ্দীন আহমদ শিবলী