সারাদেশে ভাসকুলার সার্জনের সংখ্যা মাত্র ৫৩ জন!

বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর ২০২৪

বাংলাদেশের সকল জনগণের চিকিৎসা সেবায় পদায়িত আছেন মাত্র ৫৩ জন ভাস্কুলার সার্জন। তাদের মধ্যে ৫১ জন চিকিৎসকই পদায়িত আছেন রাজধানী ও সাভারে। আবার রক্তনালির জরুরি অস্ত্রোপচারের সুবিধা আছে মাত্র একটি হাসপাতালে। জরিপ বলছে, দেশের প্রতিটি জেলায় ভাস্কুলার সার্জন পদায়িত থাকলে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও দূর্ঘটনায় আহত অনেকের অঙ্গহানি থেকে রক্ষা করা যেত।

দেশে ভাস্কুলার সার্জারির জরুরি বিভাগ রয়েছে শুধুমাত্র জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে। দেশে থাকা ৫৩ জন ভাস্কুলার সার্জনের মধ্যে হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে ২৭ জন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দুটি পদের বিপরীতে একজন, সরকারি কর্মচারী হাসপাতালে দুজনের বিপরীতে একজন, ঢাকা সিএমএইচে একজন, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিনটি পদের বিপরীতে একজন, খুলনা বিশেষায়িত হাসপাতালে একজন এবং বিএসএমএমইউতে ৯টি পদের বিপরীতে চারজন রয়েছেন। নিটোরে দুটি পদ থাকলেও বর্তমানে শূন্য। বেসরকারি ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট, ইবনে সিনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছয়জন সার্জন রয়েছেন। রাজধানীর প্রথম সারির কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতালে ভাস্কুলার সার্জারির চিকিৎসা দেওয়া হলেও এগুলোর নিজস্ব সার্জন নেই। ফলে ভাস্কুলার সার্জারির মূল ভরসা এখনো জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গত ১৯ জুলাই কিশোরগঞ্জের ভৈরবের মামুনের ডান হাত কুপিয়ে জখম করা হয়। এতে হাতের কেটে যাওয়া ধমনি ও শিরা জোড়া লাগাতে তাৎক্ষণিক রক্তনালির অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন থাকলেও স্থানীয় কোনো হাসপাতালে ওই সুবিধা ছিল না। রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (নিটোর) তাকে আনতে সময় লাগে ১০ ঘন্টার বেশি। এর আগেই হাতে রক্ত সঞ্চালন বন্ধ হয়ে যায়, মরে যায় পেশির কোষ। চিকিৎসকের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে মাংসপেশিতে পচন ধরায় মামুনের ডান হাত কনুই পর্যন্ত কেটে ফেলতে হয়।

মামুনসহ আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ অন্তত ৩০ জন হাত অথবা পা হারিয়েছেন। এ ছাড়া বিভিন্ন দুর্ঘটনায় আহতদের অনেকের ধমনি বা শিরা কেটে যায় বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাঁদের অনেকের জীবন বাঁচাতেও হাত বা পা কেটে ফেলতে হচ্ছে। অথচ সময়মতো অস্ত্রোপচার করে রক্তনালি জোড়া লাগানো গেলে তাঁদের অঙ্গহানি হতো না।

স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. সাইদুর রহমান গণমাধ্যমে বলেন, “দেশে চাহিদার তুলনায় ভাস্কুলার সার্জনের সংখ্যা খুবই কম। মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোয় চিকিৎসক বাড়ানোর যে পরিকল্পনা রয়েছে, তাতে ভাস্কুলার সার্জনদের পদ সৃষ্টির বিষয়টিও রাখা হয়েছে। স্নাতকোত্তর ডিগ্রিতে বেশিসংখ্যক চিকিৎসক ভর্তির ব্যবস্থা করতে হবে। মন্ত্রণালয় বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে।”

ভাস্কুলার সার্জনদের ভাষ্য, দুর্ঘটনা বা গুলিতে রক্তনালি ক্ষতিগ্রস্ত হলে ছয় ঘণ্টার মধ্যেই অস্ত্রোপচার করে রক্তনালিগুলোর সংযোগ করতে হবে। এতে দেরি হলে বা রক্তনালি বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলে অনেক ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীর জখম হাত বা পা কেটে ফেলতে হয়। বয়স, জীবনাচার, ডায়াবেটিস, হৃদ্‌রোগ, কিডনি রোগীসহ যেকোনো মানুষের রক্তনালিতে রোগ বা ব্লক হতে পারে।

দেশে ভাস্কুলার সার্জারিতে বিশেষজ্ঞ তৈরির প্রতিষ্ঠানও তেমন নেই। ভাস্কুলার সার্জারিতে মাস্টার্স অব সার্জারি (এমএস) ডিগ্রি চালুই হয়েছে সাত বছর আগে। বছরে এ ডিগ্রি নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন মাত্র আটজন। এ ছাড়া বছরে কার্ডিওভাস্কুলার (হৃৎপিণ্ড ও রক্তনালি) সার্জারিতে বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনস (বিসিপিএস) থেকে এফসিপিএস নিচ্ছেন অন্তত ১৫ চিকিৎসক। তাঁরা প্রশিক্ষণ নেন বিএসএমএমইউ, ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হসপিটাল অ্যান্ড রির্সাচ ইনস্টিটিউট, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট (এনআইসিভিডি), বাংলাদেশ হার্ট ফাউন্ডেশন অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট, ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল (সিএমএইচ) ও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।

বিএসএমএমইউর তথ্য বলছে, একবিংশ শতাব্দীর আগে দেশে আলাদাভাবে ভাস্কুলার সার্জারি চিকিৎসা তেমন ছিল না। তখন পর্যন্ত দুজন কার্ডিওভাস্কুলার সার্জন ছিলেন। ২০০০ সালে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে ভাসকুলার সার্জারি শাখা ও ২০১০ সালে পূর্ণাঙ্গ বিভাগ খোলা হয়। বিএসএমএমইউতে পূর্ণাঙ্গ বিভাগ খোলা হয় ২০০৪ সালে। বিএসএমএমইউতে ২০১৭ সালে এবং হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে ২০২৩ সালে ভাস্কুলার সার্জারিতে মাস্টার্স অব সার্জারির একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হয়।

জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের ভাস্কুলার সার্জারি বিভাগের প্রধান ও বাংলাদেশ ভাসকুলার সোসাইটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. আবুল হাসান মুহম্মদ বাশার বলেন, ‘কার্ডিওভাস্কুলারে যাঁরা ডিগ্রি নিচ্ছেন, তাঁরা কার্ডিয়াক সার্জারিতেই বেশি গুরুত্ব দেন। দেশে অনেক ভাস্কুলার সার্জন প্রয়োজন। আমরা হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে পদ বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছি। একই সঙ্গে দেশের বিভাগীয় সরকারি মেডিকেল কলেজে ভাস্কুলার সার্জারির পূর্ণাঙ্গ সেটআপ করার প্রস্তাব করেছি।”

উল্লেখ্য যে, শরীরে ধমনি, শিরা ও রক্ত বহনকারী ক্ষুদ্র কৈশিকনালির ক্ষতিগ্রস্ত হওয়াকে ভাস্কুলার রোগ বলে। ধমনি ও শিরার মাধ্যমে পা বা হাতে রক্ত সঞ্চালন হয়। কোনো কারণে ধমনি বা শিরা ছিঁড়ে বা কেটে গেলে রক্ত সঞ্চালন বন্ধ হয়ে যায়। ছয় ঘণ্টার বেশি রক্ত সঞ্চালন না হলে সেখানের কোষগুলো মরে গিয়ে মাংসে পচন ধরে।

প্ল্যাটফর্ম প্রতিবেদক।

Moin Uddin Ahmad Sibli

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

সার্কের ক্যান্সার বিশেষজ্ঞদের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক করেছেন প্রধান উপদেষ্টা

Thu Dec 12 , 2024
বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর ২০২৪ সাউথ এশিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর রিজিওনাল কোঅপারেশন অনকোলজির (এসএফও, ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সংগঠন) প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক করেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। আজ বৃহস্পতিবার (১২ ডিসেম্বর) ঢাকায় প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনা থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বৈঠকে যুক্ত হন তিনি। বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা এসএফও’র প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo