আজ আমরা যার সম্পর্কে জানবো, তাঁকে নিয়ে স্কুল-কলেজ লেভেলে অহরহ MCQ এসেছে। আধুনিক সার্জারির মূল তিনটা ক্ষেত্রের একটা হলো, এনাটমি সম্পর্কে সঠিকভাবে জেনে সেটার প্রয়োগ করা। আর এই ক্ষেত্রটারই উজ্জ্বল নক্ষত্র তিনি। কিন্তু অন্তরালের কাহিনীটা হয়তো অনেকেরই অজানা।
তাঁর জন্ম ১৫১৪ সালে বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে। তাঁর ক্যারিয়ার সিলেকশনের ব্যাপারটাও অনেক ইন্টারেস্টিং। প্রথমে তিনি ১৫২৮ সালে ইউনিভার্সিটি অফ লোভেন-এ আর্টস নিয়ে পড়তে ঢোকেন। কিন্তু এরপর ১৫৩৩ সালে মিলিটারিতে ভর্তি হতে ইউনিভার্সিটি অফ প্যারিস-এ চলে আসেন। এখানে এসে গ্যালেনের (Galen) থিওরিগুলো সম্পর্কে জানতে পেরে এনাটমি নিয়ে তাঁর পড়ার আগ্রহ জাগে। সেই আগ্রহের কারণে প্রায়ই তিনি কবরস্থানে হাড়গোড় দেখতে যেতেন। কিছু বুঝতে পারছেন?
তাঁর অন্যতম একটা বইয়ের নাম On the Fabric of the Human Body, এবার নিশ্চয়ই মনে পড়েছে?! বলছি আন্দ্রে ভিসেলিয়াস (Andreas Vesalius)-এর কথা।
এখন কিছুটা ফিরে দেখি। প্রথমদিকে বলেছিলাম যে আগে মানুষ মনে করতো সকল জীবের দেহের গঠন একই রকম।
১৫০ খ্রিস্টাব্দ, অর্থাৎ ১৮০০ বছরেরও আগের কাহিনী। রোমান রাজ্যে মানবদেহ ব্যবচ্ছেদ নিষেধ ছিল। তখন শূকর, ছাগল, কুকুর ইত্যাদি প্রাণীর দেহ ব্যবচ্ছেদ করে হাড়গোড় ও বিভিন্ন অঙ্গের সন্নিবেশ দেখা ছাড়া এনাটমি সম্পর্কে ধারণা নেওয়ার আর উপায়ও ছিল না। অন্য অনেকের মত সেইসময়ের বিখ্যাত গ্রিক চিকিৎসক গ্যালেনও বিশ্বাস করতেন যে মানুষের দেহের গঠনও অন্যান্য জীবজন্তুর মত। সেগুলো ব্যবচ্ছেদ করে তাঁর পাওয়া সব তথ্য নিয়ে তিনি একটা বই প্রকাশ করেন।
এদিকে তিনি ট্রাকিয়ার গঠন, ল্যারিংসের কাজ, ইত্যাদির এত নিখুঁত বর্ননা করেছিলেন যে তাঁর উপর সবার অগাধ আস্থা জন্মে গিয়েছিল। সেই আস্থা টিকে ছিল পরের ১৩০০ বছর পর্যন্ত! এর মাঝে কেউই তাঁর ধারনার সাথে দ্বিমত পোষণ করেননি (যেমন- লেফট ভেন্ট্রিকল থেকে আর্টারির মাধ্যমে রক্ত উপরের দিকে ব্রেইন, লাংসে আসে, আর রাইট ভেন্ট্রিকল থেকে ভেইনের মাধ্যমে রক্ত নিচের দিকে স্টমাকে যায়; মানুষের ম্যান্ডিবল দুইটা হাড় দিয়ে তৈরি, ইত্যাদি)। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও তাঁর বইটা পড়ানো হতো।
কিন্তু ভিসেলিয়াস কখনোই বিশ্বাস করতেন না যে জীবজন্তুর সাথে মানুষের দেহের মিল আছে। যতই পড়তেন আর দেখতেন, ততই গ্যালেনকে ভুল বলে মনে হতো। একটা মানবদেহের ব্যবচ্ছেদ বা কংকাল দেখতে পারলে এই ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যেত। নিজের এই ধারনার কথা আশেপাশে বলায় তিনি হাসির পাত্রে পরিণত হন। কেউই গ্যালেনকে অবিশ্বাস করার কথা চিন্তাও করতো না।
১৫৩৭ সালের দিকে তিনি যুদ্ধের জন্য প্যারিস থেকে লোভেন চলে গেলেন। মানবদেহ নিয়ে নিজের ধারণা পরিষ্কার করার জন্য সেখানে হাড়গোড়ের খোঁজ করতে লাগলেন। শহরের শেষ মাথায় বনে ঢাকা একটা পাহাড় ছিল, তার নিচে খোলামেলা জায়গায় সারি সারি ফাঁসির মঞ্চ। সেখানে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত লোকেদের সাঁজা দেওয়া হতো। একদিন তিনি বন্ধু Gemma Frisius (পরবর্তীকালের বিখ্যাত গণিতবিদ)-এর সাথে ওই নির্জন জায়গায় খুজতে গিয়ে একটা আস্ত কংকাল পেয়ে গেলেন। সেটা ছিল তখনকার এক দুর্ধর্ষ ডাকাতের কংকাল যাকে ফাঁসির মঞ্চে বেঁধে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এতদিন রোদে পুড়ে সেটার কোন অংশেই পচন ধরেনি। সম্পুর্ন কংকালটা শুধুমাত্র লিগামেন্টগুলোর সাহায্যে দাঁড়িয়ে ছিল।
ভিসেলিয়াস আর দেরি না করে মঞ্চে উঠে ফিমার ধরে টান মারলেন, সাথে সাথে বিভিন্ন অংশ খুলে চলে আসলো। কাজটা করতে হয়েছিল খুব সাবধানে, যাতে কেউ দেখে না ফেলে। নতুন শহরে মৃতদেহ চুরির অভিযোগ খুব গুরুতর হওয়ারই কথা! তিনি কয়েকদিন ধরে সেটার কিছু কিছু অংশ বাড়িতে এনে রাখতে লাগলেন। বুকের অংশটা লোহার খাঁচার মধ্যে আটকানো থাকায় সেটা নিয়ে একটু সমস্যায় পড়েছিলন। কিন্তু তাঁর সমাধানও বের করে ফেললেন। ভয়ডর বাদ দিয়ে গভীর রাতে সারি সারি মৃতদেহের মধ্যে গিয়ে ধীরে ধীরে সেটুকুও খুলে আনলেন। হাত-পায়ের কিছু অংশ খুঁজে না পাওয়ায় আশপাশ থেকে সেগুলোও যোগাড় করলেন।
এরপর তিনি বসলেন হাড়গুলোকে আলাদা করতে। কিন্তু লিগামেন্টগুলো শক্তভাবে লেগে থাকায় শেষপর্যন্ত ওগুলোকে সিদ্ধ করেই আলাদা করতে হলো। এরপর সেগুলোকে তিনি ছোটবেলার এক বন্ধুর বাড়ি নিয়ে গিয়ে সেখানেই জোড়া লাগালেন। সবকিছু খুব দ্রুত করেছিলেন যাতে সবাই ভাবে কংকালটা প্যারিস থেকে আনা!
মানবদেহ সম্পর্কে সবার এতদিনের ধারণা যে ভুল ছিল, কংকালটা দেখার পর তিনি সেটা আরও ভালভাবে বুঝলেন। অস্থি-র সংখ্যা, গঠন, বিন্যাস, ইত্যাদির বর্ননা করে তিনি কিছু বক্তৃতা দিলেন, নিখুঁত ছবিও দেখালেন। কিন্তু এই ব্যাপারেও সেমেলওয়াইজ রিফ্লেক্স (৩য় পর্বে বর্নিত) দেখা গেল! মানুষ তাঁর উপর ক্ষেপে উঠলো। চরম বিদ্রুপের শিকার হয়ে তিনি চলে আসলেন ইতালিতে।
সেখানকার ইউনিভার্সিটি অফ পাডুয়া ইউরোপের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মত রক্ষণশীল ছিল না, গবেষণার সুযোগও ভাল ছিল। তাই তিনি সেখানেই থেকে গেলেন। কিছুদিনেই তাঁর সুখ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো। ফলস্বরূপ ১৫৩৭ সালে মাত্র ২৩ বছর বয়সে তাঁকে সেখানকার সার্জারি এবং এনাটমির অধ্যাপক হিসাবে নিযুক্ত করা হলো। যদিও অনেক বিষয় নিয়ে তখনো গ্যালেন সমর্থকরা তাঁর সাথে তর্কে মেতে থাকতো।
১৫৪৩ সালে তিনি বাসেলে প্রথম সবার সামনে মানবদেহ ডিসেকশন করেন। পরে সেই দেহের হাড়গুলো তিনি সংযুক্ত করে বাসেল ইউনিভার্সিটিকে দিয়ে দেন (The Basel Skeleton)। এখন পর্যন্ত সেটাই পৃথিবীর সবচেয়ে পুরাতন এনাটমিকাল প্রিপারেশন, যা আজও ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের এনাটমিকাল মিউজিয়ামে রাখা আছে।
১৫৪৩ সালেই ২৮ বছর বয়সে তিনি তাঁর বই “De Humani Corporis Fabrica (On the Fabric of the Human Body)” প্রকাশ করলেন। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে আধুনিক এনাটমি নিয়ে এটাই ছিল প্রথম বই! এই বইতে বোনস, মাসল, হার্ট, ডিসেকশন, বিভিন্ন কার্যপ্রণালী যেমন আছে, সাথে নিখুঁত ছবিও আছে (Johan Van Calcar-এর আঁকা)।
বইটা প্রকাশের পরপরই তিনি রোমান রাজা ৫ম চার্লসের দরবারে নিযুক্ত হওয়ার আমন্ত্রণ পেলেন। ইউনিভার্সিটিতে কিছু ভুল বোঝাবুঝির জন্য অভিমানে তিনি রাজদরবারেই যোগ দিলেন। যদিও ব্যাপারটা সোজা ছিলা না। দরবারের অন্যান্য চিকিৎসকরা তাঁকে “বার্বার সার্জন” হওয়ায় বেশ ভালই হেনস্থা করতেন। তবুও তিনি দরবারের সাথে ঘুরে নিজের কাজ ও গবেষণা করে যাচ্ছিলেন।
কিন্তু এর মাঝেই তাঁর বিরুদ্ধে বড় বড় আঘাত আসলো। তিনি তাঁর একটা বইয়ে চিকিৎসার কিছু ভেষজ প্রণালীতে তাঁর অবিশ্বাসের কথা লিখেছিলেন। এজন্য রাজা তাঁকে শাস্তিও দেন। ধর্ম নিয়েই শেষ পর্যন্ত ভিসেলিয়াসকে ফেঁসে যেতে হয়। অনেকেই হিংসাত্নকভাবে তাঁর বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি আর ধর্মের বিভিন্ন কথায় জট পাকিয়ে রাজার কান ভারী করে তোলে। ১৫৫১ সালে রাজা তদন্তের ব্যবস্থা করলে ভিসেলিয়াস সেখানে নির্দোষ প্রমাণিত হয়। তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র তবুও চলতে থাকে।
১৫৬৪ সালে তিনি তীর্থযাত্রা করতে বের হলেন। পথিমধ্যে জেরুজালেমে খবর পান যে পাডুয়া বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে অধ্যাপক পদে আবারো আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। কিন্তু এরপরই ঘটে করুণ ঘটনাটি। আয়োনিয়ান সাগরে জান্তে উপকূলের কাছে ঝড়ের মধ্যে পড়ে ভিসেলিয়াসের জাহাজ। মাত্র ৫০ বছর বয়সে জাহাজডুবিতে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। তবুও একটা চুরি করা কংকাল থেকে আধুনিক এনাটমি এবং সার্জারির ইতিহাসের মোড় ভিসেলিয়াস এমনভাবে ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন যে আমাদের কাছে তিনি এখনো অমর হয়ে আছেন।
……….
লিখেছেনঃ আদিবা তাসনিম,
ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ ।