প্ল্যাটফর্ম সাহিত্য সপ্তাহ -৩৬
” সার্থক মাতৃত্ব (ছোট গল্প) ”
লেখকঃ
ডা. জান্নাতুল ফেরদৌস
চট্রগ্রাম মেডিকেল কলেজ ।
তৃতীয়বারের মত চিঠিটা পড়ে আবারো কিছুক্ষণ কাঁদলাম। এই এক টুকরো কাগজে যে আমার গত পনের বছরের সংগ্রামের ফলাফল দেয়া হয়েছে।
‘তন্ময় শাহরিয়ার কিশোর শাখায় চিত্রশিল্পী হিসাবে সারা বাংলাদেশের মধ্যে প্রথম হয়েছে। পুরস্কার হিসাবে আগামী পাঁচ বছরের জন্য তাকে এই বিষয়ক শিক্ষাবৃত্তি বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে প্রদান করা হবে। আগামী শুক্রবার জাতীয় জাদুঘর মিলনায়তনে প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক পুরস্কার বিতরন অনুষ্ঠানে তন্ময়ের পরিবারকে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে।’
চোখের জলের সাথে মিতালি করে মনের গহীনে লুকানো স্মৃতির কপাটটুকু আপনাতেই যেন আজ খুলে গেলো।
ছোটবেলা থেকেই মা বলতেন, নিজের পায়ে দাঁড়াতে শেখো। পড়ালেখাটা করো মনোযোগ দিয়ে। পড়ালেখার সাথে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সম্পর্কটা তখন না বুঝলেও মায়ের কথা মেনে পড়ায় কখনোই ফাঁকি দেইনি। খুব আহামরি কোন ফলাফল সারা জীবনে না করলেও নিয়মিত থাকায় ঢাকা ভার্সিটি থেকে একাউন্টিং এ মাস্টার্সের গন্ডি পেরোতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। আর তারপর তো আর দশটা মেয়ের মতো বিয়ের পিড়িতে বসা।
বাসার পছন্দেই মারুফের সাথে আমার বিয়ে হয়। উচ্চশিক্ষিত ছেলে সম্ভাবনাময় ভবিষ্যত, ঐ পারিবারিকভাবে বিয়েতে আর সবাই যা দেখে সেসব দেখেই আমাদের বিয়েটা হয়। খারাপ বিয়ে হয়েছে বা মারুফ খারাপ মানুষ এসব আমি এখনো বলবোনা। আর ওর উত্সাহেই তাই ব্যাংকিং জবে ঢোকা। ভালোই যাচ্ছিলো দিন, সুখে দুঃখে, হাসি আনন্দে। দুবছর না ঘুরতেই পুরো পরিবারের পীড়াপীড়ি শুরু হয়, কেন বাচ্চা নিচ্ছোনা, আর কতদিন মুক্ত পাখি হয়ে ঘুরবা, কার সমস্যা ইত্যাদি ইত্যাদিতে আমাদের দুজনের প্রানই ওষ্ঠাগত; অথচ আমরা নিজেদের জন্য আরো এক দুবছর সময় নেবো ভাবছিলাম।
তারপর এক সকালে পেলাম আমাদের দুজনের জীবনে নতুন কারো আগমনবার্তা। সুখের আবেশে কোন রকম জটিলতা ছাড়া চোখের নিমিষেই যেন কেটে গেলো পুরোটা প্রেগন্যান্সি। বাচ্চা হলে যদি আবার পড়াশোনায় ব্যাঘাত হয় তাই খানিকটা কষ্ট হলেও ব্যাংকিংয়ের পরীক্ষাগুলো দিয়ে নিজেকে গুছিয়ে রেখেছিলাম, যেন পরবর্তীতে প্রমোশন পেতে ঝামেলা না হয়। দশ মাসের অপেক্ষার পর আমার কোলজুড়ে এলো আমার রাজপুত্র তন্ময়।
আমার মাতৃত্বকালীন ছুটি কাটিয়ে কাজে ফিরলাম। মারুফ ততদিনে নতুন ব্যবসা নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত। দিনের নিয়মে দিন গড়ায়। আমার তন্ময় হাঁটি হাঁটি পা পা করে সারা ঘর দৌড়ে বেড়ায়। আমি শুধু অবাক হয়ে তার বেড়ে ওঠা দেখি। কিন্তু সে কি বয়স প্রায় দুই পেরিয়ে তিন শুরু হয়েছে কিন্তু তন্ময় কাউকে ডাকেনা, কথা বলাতো দূরের ব্যাপার। যাবতীয় আগ্রহ রংতুলি নিয়ে। পছন্দ করে বিধায় আমিও নানারকম রংয়ের জিনিসপত্র কিনে দিতাম। তারপর সত্যিই টনক নড়ে যখন মারুফের বন্ধুর দুই বছরের বাচ্চা বেড়াতে আসে বাসায়। ওর কথার চোটে সবার অবস্থা খারাপ। আর সেখানে আমার ছেলেটা কারো সামনে পর্যন্ত এলোনা। পরদিনই ছুটলাম শিশু বিশেষজ্ঞের কাছে।
সেই রাতটার কথা আমার আজো মনে আছে। সারারাত দুচোখের পাতা এক করতে পারিনি। শিশুবিদ বলেছে আমার ছেলে নাকি অটিস্টিক। চেষ্টা করলে হয়তো কিছু কথা বলতে পারবে, কিছুটা সমাজে চলার মতও হবে; কিন্তু কখনোই সে একজন স্বাভাবিক মানুষের মত হতে পারবেনা। শিশুবিদের কাছ থেকেই এ ধরনের শিশুর যাবতীয় সাপোর্ট সিস্টেমের কাগজ ও তথ্য নিয়ে বাসায় আসি।
শুরু হয় আমার নতুন যুদ্ধ। মারুফ কিছুদিন সাথে সাথে থাকলেও আমাদের চেয়ে ওর ব্যবসা, ওর জীবনের আনন্দ ওর কাছে অনেক বেশী প্রাধান্য পায়। আর তাই যখন জানতে পারি মারুফের আরেকটা সম্পর্ক হয়েছে কারো সাথে খুব একটা অবাক হইনি। ওর বিগত কয়েকমাসের আচরণের এরকম একটা ব্যাখ্যাই আমি খুঁজছিলাম। একবার তো বলেই বসলো তোমার অসুস্থ ছেলের খরচ টানতে টানতে আমার জীবনটাই শেষ।
একরাতে তন্ময়ের বাড়াবাড়ি রকমের জ্বর আসে। হাসপাতালে নেয়ার পথে অনেকবার মারুফকে ফোন দেই। সেই ফোনের উত্তর দেয়ার সময় সে পায়, পরদিন সকালে। অফিসের কাজে তাকে জরুরী ভিত্তিতে কক্সবাজার যেতে হয়েছিল। অথচ সে কেন কক্সবাজার যাচ্ছে তা ওর অফিসের আরো অনেকের থেকে আমি আগেই জেনে গিয়েছিলাম। হাসপাতালের দিনগুলোতেই সিদ্ধান্ত নেই মারুফের জীবন থেকে সরে দাঁড়ানোর।
তন্ময়ের জন্মের সময় মা আমার এক দুঃসম্পর্কের আত্মীয়কে আমাকে সাহায্য করার জন্য দেন। সেই খালা ছাড়া আর কাউকে পাইনি আমার এই সিদ্ধান্তে আমার পাশে দাঁড়ানোর মত। উনিও যে আমার মতই ভুক্তভোগী ছিলেন।
জীবনে তখনই প্রথম বুঝতে পারি নিজের পায়ে দাঁড়ানো বলতে মা আসলে কি বুঝাতে চেয়েছেন। শুধু নিজের চাকুরীটুকু ছিলো দেখেই নিজের আত্মসম্মানটুকু নিয়ে সরে আসতে পেরেছিলাম। তারপর থেকে আজ এতটা বছর একাই ছেলেকে নিয়ে লড়ে গেছি। একেকটা দিন ছিল একেকটা বছরের সমান। আজ স্পিচ থেরাপি তো কাল অকুপেশনাল থেরাপি; পরদিন হয়তো সাইকোলজিস্ট। আর এই ঐ শরীর খারাপতো ছিল নিত্যদিনের ব্যাপার। দুদিন পরপর পেটে হাগু আটকে যেতো। দৌড়াও হাসপাতাল; পেট পরিস্কার করাও। আর প্রতিবার হাসপাতাল থেকে ফেরা কোন বাড়তি অসুখ নিয়ে। কত রাত যে ঠিকমত ঘুমাইনি সেটা বোধহয় নিজেও জানিনা।
কোন বাঁধাধরা নিয়মে ছেলে চলতে চাইতোনা। শুধু রংতুলি হাতে দিলে অনেকটা সময় চুপ রাখা যেত। স্পেশাল স্কুল, আমার সেই খালার যত্ন আর অফিস থেকে ফিরে আমার দেয়া প্রতিটা মূহুর্ত একটু একটু করে ছেলেকে এখানে আনার ভিত্তিটুকু করে দিয়েছে। কিভাবে যে ছেলেকে সামলে চাকুরী করেছি আমি এখনো মাঝে মাঝে ভেবে পাইনা। বহুজন বহুমতে কোন না কোন অজুহাতে বারবার পাশে ভিড়তে চেয়েছে। নিজের লক্ষ্যে পৌঁছাতে শুধু দাঁত কামড়ে লড়ে গেছি এতটা বছর আজকের দিনটার জন্য।
শেষ বিচারের আমলনামায় বিধাতা আমার জন্য কি লিখে রেখেছেন আমি জানিনা; কিন্তু পৃথিবীর আমলনামাটুকু তিনি আমাকে যে অসীম করুণায় আজ ভরে দিয়েছেন তার জন্য আরেকবার বুঝি চোখের জলে বুক ভাসানোই যায়।
‘আমি অকৃতি অধম বলেওতো কিছু
কম করে মোরে দাওনি,
যা দিয়েছো তারই অযোগ্য ভাবিয়া
কেড়েও তো কিছু নাওনি।’