প্ল্যাটফর্ম সাহিত্য সপ্তাহ -৪৭
“সায়াহ্ন”
লেখকঃ সামিরা অাফরোজ
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ ।
সোবহান সাহেব বাড়ির বারান্দায় বসে নিজের হাতে লাগানো গাছগুলোর দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে অাছেন।আকাশে মেঘ ডাকছে।হয়তো বৃষ্টি হবে,হয়তো বা না।আজ থেকে প্রায় ত্রিশ বছর আগে সোবহান সাহেব তার দুই ছেলেমেয়েকে সঙ্গে নিয়ে এই গাছগুলো লাগিয়েছিলেন। কড়ই,নিম,সেগুন গাছ,ফুলের বাগান সবই রয়ে গেছে,শুধু আজ পাশে নেই তাঁর দুই ছেলেমেয়ে।?মেয়ে, জামাইসহ অস্ট্রেলিয়ায় থাকে।আর ছেলে,পুত্রবধূ,নাতি-নাতনি কানাডায় থাকে।চার-পাঁচ বছর পরপর তারা বাংলাদেশে বেড়াতে আসে।লোকে বলে,সোবহান সাহেবের সুখের সংসার।দুই ছেলেমেয়ে প্রতিষ্ঠিত।ভাল চাকরি করে।কিন্তু আসলেই কি সুখী সোবহান সাহেব?আর কোন চিন্তা এইমুহূ্র্তে মাথায় আসছে না।মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে।একটু চা খেতে পারলে বোধহয় ভালো হতো।
হঠাৎ করেই চায়ের কাপ হাতে লুৎফা বেগমের প্রবেশ।কি আশ্চর্য!লুৎফা বেগম কিভাবে সোবহান সাহেবের মনের কথাটাই পড়ে ফেললেন!”বসো এই চেয়ারটাতে,কিছু কথা বলি।”লুৎফা বেগম চেয়ারে বসতে বসতেই বললেন,”কি বলবা তাড়াতাড়ি বলো,চুলায় তরকারি বসিয়ে এসেছি।”
“মনে পড়ে লুৎফা সেই দিনটির কথা,যেদিন আমাদের এই স্বপ্নের বাড়িটা তৈরি করা শেষ হলো?তোমার চোখে-মুখে তখন এক চাপা আনন্দ!লিস্ট করতে বসে গিয়েছিলে বাড়ির পর্দার রং কেমন হবে,,কেথায় কোন জিনিসটা সাজাতে হবে।আমার আয় ছিল কম,তাই তুমি আমাকে না জানিয়ে বিয়ের গয়নাগুলো বিক্রি করে দিয়েছিলে।আমি সেই টাকা নিতে চাইনি বলে,তুমি বলেছিলে,যখন সামর্থ্য হবে,তখন আবার বানিয়ে দিও।আমার প্রতিটি কষ্টের টাকা তুমি তোমার সাধ্যমত হিসাব করে বাড়িটাকে সুন্দর করে সাজিয়ে তুলেছিলে।তার দুই বছর পর আসিফের জন্ম হল।জন্মের সময় ওর সে কি কান্না!মনে হচ্ছিল হয়তো পৃথিবীর নির্মমতা তখনই কিছু বুঝতে পেরেছিলো।” “হুম,তুমি যখন ওকে কোলে নিতে,মনে আছে,ও দুই চোখ মেলে অবাক হয়ে তোমাকে দেখত।এইরে,দাঁড়াও তরকারিটা নামিয়ে আসি।”
সোবহান সাহেব আবার বারান্দা দিয়ে বাইরে তাকালেন।খেয়ালই করেননি এতক্ষণ, বাইরে বৃষ্টি শুরু হয়ে গিয়েছে।বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে আজ তাঁর বড্ড কাঁদতে ইচ্ছা করছে।বৃষ্টির পানিতে দাঁড়িয়ে কাঁদার এই একটা মজা,কাঁদলেও কেউ বুঝে না।বৃষ্টির পানি চোখ ধুয়ে দিয়ে যায়।আচ্ছা তিনি কি খুব বেশি কিছু চেয়েছিলেন জীবনে?তিনি শুধু চেয়েছিলেন ছেলেমেয়েকে নিয়ে একসাথে থাকতে।নাতি-নাতনিকে নিয়ে একটি সুখের সংসার চেয়েছিলেন।কিন্তু তা আর হল কই?বড্ড নিঃসঙ্গ লাগে,মনে হয় ভূতের বাড়িতে থাকেন।বাড়িটা বড্ড ফাঁকা ফাঁকা লাগে।তাঁর কি ইচ্ছা করে না,এই বুড়ো বয়সে একটু নাতি-নাতনিদের সাথে গল্প করতে।
“কি ব্যাপার, কি চিন্তা করছ এত?তোমার না হাই-প্রেশার।”
“বুঝলে লুৎফা,চিন্তা করতে চাই না,কিন্তু চিন্তা যে আমায় ছাড়ে না।আচ্ছা লুৎফা বলো তো এমন কোন মৌলিক সংখ্যা যা দ্বারা ১১১,২২২, ৩৩৩, ৪৪৪, ৫৫৫,৬৬৬,৭৭৭, ৮৮৮, ৯৯৯ নিঃশেষে বিভাজ্য?”
“উফ!তোমার এই মাস্টারির অভ্যাস জীবনেও গেলো না,পারি না,বলে দাও।” “হাহাহা, উত্তরটা হচ্ছে ৩৭।মনে আছে মেয়েটা অঙ্ক করতে অনেক ভালবাসতো?রাত জেগে পড়তো।আর তুমি তার পাশে বসে থাকতে,কখন কি লাগবে..আচ্ছা মেয়েটা তো বাবা বলতে পাগল ছিলো লুৎফা,,ও কি করে এই বুড়ো বাবাটাকে ভুলে গেলো বলো তো??সপ্তাহে বা মাসে একবার ফোন করে।এই বাবার মন কি চায় না একটু ছেলেমেয়েদের সাথে কথা বলতে,একটু তাদের সাথে সুখ-দুঃখের আলাপ করতে।কিন্তু ফোন দিলে ধরে না,আর যদিওবা ধরে, বলে,বাবা ব্যস্ত আছি,পরে ফোন করব।সেই পরে হয়ত আরও এক সপ্তাহ পর।ওরা ওখানে নিয়ে যেতে চেয়েছিলো,যাইনি কারণ এই বাড়িতে যে আমাদের অনেক স্মৃতি।”?
“তুমি খামোখা এসব নিয়ে চিন্তা করছো।কি হয়েছে বলো তো তোমার?একটু বসো তো, এভাবে পায়চারি না করে।আর এক কাপ চা দিব?”
“না,আর চা খাব না,মাথাটা কেমন জানি করছে।জানো লুৎফা আজ না খুব কাঁদতে ইচ্ছা করছে।মনে আছে,ছোটবেলায় আসিফের যখন তিন বছর বয়স,কি ভীষণ জ্বর হয়েছিলো ছেলেটার।তুমি সারারাত ছেলেটার মাথার কাছে বসেছিলে,আর ওর সেবা করছিলে।ও যেদিন সুস্থ হলো,সেদিন তোমার মুখে সে কি হাসি!আচ্ছা ওদের কি একবারও আমাদের কথা মনে পড়ে না?”
“হয়তো পড়ে,হয়তো বা না।কি জানি?আচ্ছা সম্পর্কগুলো কিভাবে ঠুনকো হয়ে গেলো বল তো?আমাদের এত ভালবাসাও বেঁধে রাখতে পারলো না ছেলেমেয়ে দুটিকে।একটা সুখের ভবিষ্যতের জন্য আজ তারা বিদেশে।ওরা ওদের ক্যারিয়ারকেই প্রাধান্য দিলো।একদিন পথ চলতে চলতে ওরাও ক্লান্ত হয়ে যাবে।আর কোন এক বিকেলে বসে স্মৃতি রোমন্থন করবে ঠিক আমাদের মতো।”
“বুঝলে লুৎফা,তুমি যদি আমার পাশে এই সময়টাতে না থাকতে,কিভাবে যে দিনগুলি পার করতাম?আমার প্রতিটা সুখের সময়,দুঃখের সময় তুমি আমার পাশে ছিলে।আল্লাহর কাছে শেষ একটিই চাওয়া,যেন জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তুমি আমার পাশে থাকো।লুৎফা বুঝলে,আমাদের এই বয়সটা এমনই,যেই বয়সের প্রতিটা কথা,কাজ আমাদের ছেলেমেয়েদের সাথে তাল মেলাতে পারে না।তাই আমরা তাদের কাছে ব্যাকডেটেড।আর তারা আল্ট্রামডার্ণ।তাদের কাছে হয়তো এই বুড়া-বুড়ির চাওয়া পাওয়া গুলোর কোন মূল্য নাই।?তারা তাদের বাবা-মার নিঃস্বার্থ ত্যাগ,ভালবাসাকে অস্বীকার করে।নিজেদের জীবন নিয়ে যে তারা বড় ব্যস্ত।পিছে তাকানোর সময় যে তাদের নাই।তাই হয়তো ছোটবেলার সেই পরিবারের সাথে কাটানো মুহূর্তগুলো তাদের মনে দাগ কাটে না।মনে পড়ে না বাবা-মায়ের আদরের কথা।কোনদিন হয়তো মরে গেলে, বিদেশ থেকে আসার সময়টুকু পর্যন্ত হবে না।”??
“তুমি এসব কথা একদম বলবে না তো,আল্লাহ যা ভাগ্যে রেখেছেন তাই হবে।”
দূর থেকে মাগরিবের আযান ভেসে আসছে।লুৎফা বেগম উঠে পড়লেন।সোবহান সাহেব যাওয়ার আগে কি মনে করে একবার কড়ই গাছের দিকে তাকালেন,সেখানে মা-পাখি তার বাচ্চাদের জন্য মনে হয় খাবার এনেছে।বাচ্চা পাখিগুলো ঠুকরে ঠুকরে খাচ্ছে।কি সুন্দর সংসার পাখিগুলোর!☺দেখে বড্ড হিংসে হচ্ছে সোবহান সাহেবের।ওদের জীবনই মনে হয় অনেক সুন্দর!নেই কোন জীবনের নির্মমতা,নিষ্ঠুরতা,নেই কোন একাকিত্ব।সোবহান সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওযু করতে চলে গেলেন।??
প্রত্যেক বাবা-মায়ের ইচ্ছা থাকে জীবনের সায়াহ্নের এই সময়টুকু সন্তানদের সাথে কাটাতে।কিন্তু অনেক সন্তানেরা বাবা-মায়ের এই শেষ ইচ্ছাটুকু পূরণ করে না।অনেক বাবা-মায়ের আবার শেষ ঠিকানা হয় বৃদ্ধাশ্রমে।?সন্তানদের বোঝা উচিত জীবনের এই সময়টা তাদেরকেও পার করতে হবে।তাই প্রতিটি পরিবার হোক আনন্দময়।বৃদ্ধ বাবা-মায়েদের এই জীবনের শেষ মুহূর্ত গুলো যেন একাকিত্বে না কাটাতে হয়,তারা যেন তাদের পরিবারের মাঝেই জীবনের শেষ দিনগুলো একটু আনন্দে কাটাতে পারে,এটাই হোক সকল সন্তানদের প্রত্যাশা।
ভালো লাগল ।
আসলে এই প্রজন্মের যারা তারা ভাবে তারা এগুচ্ছে । সত্যি কি তাই ! কেরিয়ারই কি সব ? জানিনা । তবে এটা ঠিক উপরে কোন ব্যাংক নেই । আর একটা কথা তুমিও একদিন ওই বয়স পাবে আর সেদিন কি হবে ভাবো ।
লেখককে ধন্যবাদ ।