৭ মে, ২০২০, বৃহস্পতিবার
ডা. মাহবুব মুতানাব্বি
সহযোগী অধ্যাপক, শিশু বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
সুইডিশ মডেলের ঘড়ি, সুইডেনের বিখ্যাত ভলভো মডেলের গাড়ির কথা আমরা সবাই জানি। ১৯৭২ সনে প্রতিষ্ঠিত সুইডেনের অ্যাবা (ABBA) পপ গ্রুপ সত্তুর দশকে তরুণদের পুরো মাতিয়ে রাখে। ‘আব্বা ‘ থেকে না, শব্দটা এসেছে গ্রুপের চারজনের নামের আদ্যক্ষর মিলিয়ে। গ্র্যামি ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অনেক পুরস্কার জেতে তখনকার তারুণ্যের এ ক্রেজ।
স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোর মধ্যে কথাবার্তা, চালচলন, সংস্কৃতি অনেক কিছুর সাদৃশ্য আছে। আন্তর্জাতিক বিবাদ থেকেও এরা সাধারণত দূরে থাকতে চায়। এজন্য জনগণের নিরাপত্তা ও স্বাচ্ছন্দ্যে এরা বেশি উদ্যোগ নিতে পারে। কিন্তু এবার সুইডেন হাঁটলো ভিন্নপথে। সবাই যখন দুয়ার দিচ্ছে ঘরে, সুইডেনে সব খোলা।
স্কুল, কলেজ, শপিংমল সব খোলা। সমাবেশের উপর ও বড় কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। সুইডিশ স্কুল অব হেলথ ইকোনমিক্সের ম্যানেজিং ডিরেক্টর পিটার লিন্ডগ্রে বলেছেন, ‘অনেক সময় ধরে হয়তো এটা চালাতে হবে। এভাবে সবাইকে আটকে রাখা সম্ভব না।’
প্রতিবেশী ডেনমার্ক ও নরওয়ে অতি দ্রুত স্কুল, কলেজ, বিপণীবিতান সব বন্ধ করে দিয়েছে। এর ফলাফল হচ্ছে ভিন্নরকম। সুইডেনে যখন মৃত্যুর সংখ্যা ১২০০ র মতো, ডেনমার্কে তখন ২০০ এর কাছাকাছি। নরওয়েতে আরো কম। কিন্তু সুইডেনের প্রধান এপিডেমিওলজিস্ট অ্যান্ড্রেস টেগনেল বলেন, এটাই সঠিক পন্থা। তিনি বলেন, ইমিউনিটি অর্জন করাই সুইডেনের মানুষের জন্য ভালো হবে। তিনি অবশ্য হার্ড ইমিউনিটির কথা বলেন নি।
৯ এপ্রিলে সুইডেনে মৃত্যু অনেক বেড়ে গেল। হাসপাতাল ভারাক্রান্ত। চিকিৎসকরা ক্লান্ত, পর্যুদস্ত। তখন মিলিটারি ফিল্ড হসপিটাল খোলা শুরু হল। এক কোটি লোকের দেশে ৪০ লাখ আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা করা হল। সুইডেনের অনেক মানুষই এ রকম এক্সপেরিমেন্টে বিরক্ত হল।
ক্যারোলিনস্কা ইন্সটিটিউটের ভাইরোলজিস্ট সিসিলিয়া সডারবার্গ বলেন, ‘আমি এ পরীক্ষণে অন্তর্ভূক্ত হতে সজ্ঞানে সম্মতি দেই নি। আমি জানি না, কেমন দেশে আছি, যারা নিজেদের জনগণের সুরক্ষা দেয় না।’
এইসময়ে নরওয়ে ৫ জনের বেশি লোকের সমাবেশ নিষিদ্ধ করে। ঘরে ৬ ফুটের বেশি দূরত্ব রাখার নির্দেশ দেয়। ডেনমার্ক সব সীমান্ত বন্ধ করে দেয়। ১০ জনের বেশি সমাবেশ নিষিদ্ধ করে।
সুইডেন বিপরীতে ৫০০ লোকের সমাবেশ অনুমোদন করে। ট্রেগনেল বলেন, ‘আমরা কন্টেইনমেন্ট ফেইজে নাই। মিটিগেশন ফেইজে আছি। ‘অবশ্য সরকার সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার পরামর্শ দেয়। সুইডেনের স্বাস্থ্যমন্রী লেনা হ্যালারগ্রেন বলেন, ‘লক ডাউন হয় নি। অনেকে নিজেরাই শাট ডাউনে আছেন।’
তিনি কিছু তথ্য তুলে ধরেন। গণ পরিবহনে যাত্রী ৬০% এ নেমে গেছে। স্কি রিসোর্টগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। গটল্যান্ড হলো অবকাশযাপনের জন্য এক মনোরম দ্বীপ (আমাদের কক্সবাজার, সেন্ট মার্টিনের মত)। ইস্টারে সেখানে ৮৫-৯০% পর্যটক কমে গেছে। কিন্তু কোভিড রোগী বেড়ে হাসপাতালের উপর যখন চাপ সৃষ্টি হল, সরকার তখন ৫০ জনের বেশি সমাবেশ নিষিদ্ধ করলো। একটি সম্মেলন কেন্দ্রে মিলিটারি হাসপাতাল নির্মিত হলো।
এখন পর্যন্ত সুইডেনে আক্রান্ত ২২,৭২১। মৃত্যু ২,৭৬৯। পক্ষান্তরে ডেনমার্কে আক্রান্ত ৯,৮২১। মৃত্যু ৪৯৩। নরওয়েতে আক্রান্ত ৭,৯০৪। মৃত্যু ২১৪। সুইডেনের যুক্তি হচ্ছে, অন্যরা ০% কাজ করছে একশ পারসেন্টে ফেরার জন্য। আর সুইডেন সবসময় ৩০% বজায় রাখছে। রাজতান্ত্রিক দেশ সুইডেনে এসব সিদ্ধান্ত কিন্তু কোনো রাজা বা প্রধানমন্ত্রী নিচ্ছেন না। পাবলিক হেলথ এজেন্সি স্বাধীন সংস্থা। কোনো মন্ত্রী ও হস্তক্ষেপ করলে তার চাকরি নট।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, অন্য কোনো দেশ সুইডেনের মত পুরা খোলা নীতি নিতে পারে কিনা এই সংকটে? ইতোমধ্যে সডারবার্গ সহ ২০০০ বিজ্ঞানী সুইডিশ সরকারকে নীতি বদলাতে বলেছেন। যুক্তরাজ্য ও নেদারল্যান্ডস হার্ড ইমিউনিটির নীতি প্রথমে নিলে ও ক্যাজুয়েল্টির মাত্রা চিন্তা করে সরে এসেছে। তাহলে আগে দেখি কি কি বৈশিষ্ট্যের কারণে সুইডেন এত বড় ঝু্ঁকি নিতে পেরেছে?
ক. সুইডেনের আয়তন ৪,৫০,২৯৫ বর্গকিলোমিটার। লোকসংখ্যা প্রায় এক কোটি তেইশ লাখ। জন ঘনত্ব প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ২৫ জন (বাংলাদেশে হাজারের উপরে)।
খ. আয় বন্টনের জিনি সহগ .২৭।
গ. সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা ও উচ্চশিক্ষা সব নাগরিকের মৌলিক অধিকার।
ঘ. বিশ্বের ১১ তম সর্বোচ্চ মাথাপিছু আয়ের দেশ।
ঙ. স্বাস্থ্য, শিক্ষা, নাগরিক স্বাধীনতা, লিঙ্গসমতা সবক্ষেত্রেই জীবনমান অতি উচ্চ।
চ. চিকিৎসা ব্যবস্থা অতি উন্নত মানের। আই সি ইউ সদা প্রস্তুত। চিকিৎসা বা সুরক্ষা সামগ্রীর কোনো অভাব নেই।
ছ. ইন্টারনেট দ্রুতগতির এবং সহজলভ্য।
জ. অর্ধেকের বেশি সুইডিশ বাড়িতে মাত্র একজন মানুষ থাকে।
ঞ. বাড়িতে থেকে কাজ করে প্রচুর লোক।
এমনিতেই এখানে এক মানুষ থেকে আরেক মানুষে অনেক দূরত্ব। আবার সরকার চাপ না দিলেও জনগণই অনেকে সচেতন। টার্মিনাল থাকে খালি। চেরী ফুলের পার্কেও গাদাগাদি ভীড় নেই। বাসা থেকে অফিস চলে।
এসব কারণেই পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান লিন্ড বলেছেন,
It’s a myth that life goes on as normal in Sweden.