প্ল্যাটফর্ম সাহিত্য সপ্তাহ -১
“সুবর্ণ এক্সপ্রেস”
ট্রেনের টিকেটের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। এই ঈদের মৌসুমে টিকেট পাব কিনা জানিনা, ঈদের আমেজের কাছে এই দাঁড়িয়ে থাকা নেহাত কিছুই না। ভালোই লম্বা লাইন, আমার পজিশন প্রায় শেষ থেকে সামনের দিকে। সামনে এক টুপি পড়া ভদ্রলোক আর পিছনে একটা মেয়ে দাঁড়িয়েছে। মাঝেমধ্যে ফোনটা বের করে একটু নিউজ ফিড ঘাটছি। হঠাৎ লাইনের মধ্যে আমার সামনে দিয়ে এক মোটাসোটা লোক ক্রস করে গেল। আমি একটু ধাক্কা খেয়ে পিছে হেলে পড়লাম, আর পা গিয়ে পড়ল পিছনের মেয়েটার পায়ের উপর। খেয়াল করতেই তড়িঘড়ি করেই তাকে সরি বললাম।
-সমস্যা কি আপনার?
-সরি আপু, খেয়াল করিনাই৷
-ফাইজলামি করেন?
-সিরিয়াসলি আমি খেয়াল করিনাই। আমি এক্সট্রিমলি সরি। কিছু মনে করবেন না প্লিজ
সে আর কিছু বলল না। মনে তো হলো সে বুঝেছে যে ইচ্ছা করে করিনি, বোধহয় ব্যাথাটাই তার রাগের কারণ। যাহোক রাগতেই পারে, রাগুক, আমার কি।
লাইন মনে হচ্ছে আগাচ্ছেই না। ওয়াশরুমে যাব, লাইন ছাড়তেও পারছিনা৷ একটু সাহস করে অই পিছনের মেয়েটাকেই বললাম, একটু জায়গাটা রাখবেন প্লিজ, আমি এক্ষুণি আসতেছি। সে হ্যা না কিছুই বলল না, আমিও এত মনযোগ দিয়ে তার হ্যা না শোনার প্রয়োজন বোধ করলাম না, মৌনতা সম্মতির লক্ষণ ভেবে বের হয়ে আসলাম।
ওয়াশরুম থেকে ফিরে আসলাম৷ টুপিওয়ালা লোকটার পিছনেই আপু, এদের দুজনের মাঝে গ্যাপটা ছোট হয়ে গেছে মনে হচ্ছে৷ কাছে গিয়ে দাড়ালাম, আমি সামনে আসাতেও মেয়েটি দাড়ানোর জায়গা করে দিল না।
-আপু জায়গাটা…
-কিসের জায়গা। আপনি তো চলে গেছেন
-আপনাকেই না বললাম জায়গাটা রাখতে
-কই? কখন কাকে বললেন?
কথা শুনে মেজাজটা খারাপ হলো। বুঝে গেছি যে মেয়েটা ভালো তর্ক করতে পারে, তাই কথা বাড়ালাম না, আমিই রাগ করে পিছে চলে আসলাম। ব্যাপার না, মাত্র সাত আটজনের পিছেই। এমনিও তো তখন লাইনের শেষের দিকে ছিলাম৷ মেয়েটাকে দেখে সমবয়সী মনে হচ্ছিল, ইচ্ছা হচ্ছিল কষে একটা থাপ্পড় দিতে, তাহলে খুব শান্তি লাগত৷
কিছুক্ষণ পর শুনলাম ১৬ তারিখে চিটাগাং এর টিকেট শেষ। নিজে একটু হতাশ হলেও মেয়েটাকে দেখে তখন খুশি লাগছিল। মন ভরে লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে টিকেট নিক এবার। আমি ছেলে মানুষ, টিকেট না পেলেও কোনোভাবে ম্যানেজ করে নিব।
একটু পরেই একটা লোক আমাকে ডাক দিল।
-ভাই চিটাগাং যাবেন?
-জ্বী, ১৬ তারিখ
-আমার কাছে দুইটা টিকেট আছে
-আচ্ছা তাহলে আমি একটা নিব
-একটা তো বিক্রি করব না, আপনি আরেকজনকে পান কিনা দেখেন বা দুইটাই নেন।
এ সময়ে টিকেট পাওয়া মুশকিল। দুইটা নিলেও লস নেই, লোকের অভাব নেই এখানে, আরেকজন পাওয়া যাবে। সুযোগের সদ্ব্যবহার করাই উত্তম, এই ভেবে দুটোই নিলাম, ৩৮০ টাকার শোভোন চেয়ারের টিকেট ৬০০ করে নিলো। কি করার, নিরুপায় হয়ে নিতেই হলো।
সামনেই দেখলাম মেয়েটাও এদিক ওদিক ঘুরছে। আমি টিকেটটা হাতে নিয়ে উনাকে দেখাতে দেখাতেই হাটতে লাগলাম। সেও খেয়াল করে ফেলল। বাহ বেশ, তার নজর দেখে আমার ভালোই লাগল, তবে তার নজর কিসে তা চোখ দেখেই পড়ে নিলাম। মনে খুশির লাড্ডু ফুটছিল। খুব ভালো হয়েছে। হঠাৎ মেয়েটা এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল
-ভাইয়া টিকেট পেয়েছেন?
– জ্বী ২ টা
-আপনি কি একা যাবেন?
-জ্বী, একটা সেল করব
এবার একটু হাসিমুখে বলল
-ভাইয়া তাহলে আমিই নিই। এত কষ্ট করে তো কাউকে খোজার দরকার নেই।
যাই বলবে ভেবেছি, তাই বলল। নাহ, অভদ্র হওয়া যাবে না। আমি ভদ্র ছেলের মতো উনাকেই টিকেট দিলাম। টিকেট জোড়া, দুইসিট এক টিকেটেই লিখা। ওটাই দিলাম। যাবে যখন আসতে তো হবেই।
১৬ তারিখ স্টেশনে এসে ফোন থেকে বের করে আগে থেকে ছবি তুলে রাখা টিকটটা দেখলাম। সুবর্ণ এক্সপ্রেস, চ বগি, ১৩-১৪ নাম্বার সিট। প্ল্যাটফর্মে ঢুকে মেয়েটার সাথে দেখা, ভালোই হলো, একসাথেই উঠি।
১৮ নাম্বার পিলারের কাছে চ বগি। একদম ঘাড়াঘাড়ি করে আসছি। ট্রেনের ইঞ্জিন স্টার্ট দেওয়া হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। মেয়েটা আগে উঠল, আমি উঠব মাত্রই
-ওহ ওহ ভাইয়া ভাইয়া…আমি না ছাতাটা ফেলে আসছি। ৫ কি ৬ নাম্বার পিলারের ওখানে বসছিলাম। প্লিজ একটু দৌড় দিয়ে এনে দেন।
-ট্রেন তো ছেড়ে দিচ্ছে
-আপনি ছেলে মানুষ, একটু কষ্ট করে দৌড় দেন, পারবেন।
নিজের পুরুষত্বের পরিচয় দিতে গিয়ে তাই করলাম। ট্রেন আস্তে আস্তে রান করা শুরু করেছে অলরেডি। নিজের মধ্যেও একটা হিরো হিরো ভাব আসতে লাগল, ভাবলাম এখন যদি এমন হয় মেয়েটা এখন ট্রেনের দরজার সামনে এসে হাত বাড়াবে, আর আমি কাধে ব্যাগ, এক হাতে ছাতা আরেক হাত বাড়িয়ে দিয়ে তাকে ধরে উঠব, আহ কি রোমান্টিকই না হবে, পাশে কয়টা লাইভ ক্যামেরা থাকলেও বেশ হতো। ভাবতে ভাবতে ট্রেনের গতি একটু বেড়ে গিয়েছে। ছাতা পেয়ে গেছি, দৌড় শুরু করলাম। তবে একটু বোকামি করে ফেললাম, প্রথমেই যেই বগিটা পেলাম সেটাতে উঠলেই পারতাম। কল্পনাকে বাস্তব করার জন্য সেই চ বগিতেই উঠার জন্য দৌড়াচ্ছি, সামনেই চ বগি, কিন্তু মন ভেঙে গেল যে কাছাকাছি গিয়ে দেখলাম মেয়েটা হাত বাড়ানো তো দূরের কথা, দরজাতেও নেই৷ জাস্ট জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখছে হয়ত, খেয়াল করিনি সেটা৷ ট্রেনের গতি আর আমার দৌড়ের গতি একই। আমি তো ভালোই জোরে দৌড়াচ্ছি, এই স্পিডে আর লাফ দিয়ে উঠে পড়ার সাহস হলো না।
যাহ শিট! মিস হয়ে গেল৷ এবার নিজের গালেই থাপ্পড় দিতে ইচ্ছা হলো, কেন যে হিরো হিরো ভাব নিতে গেলাম৷ ছাতাটাকে একটা আছাড় মারলাম। মনে মনে দশবার বললাম এ জীবনে আর কোন মেয়ের উপকার করব না।
যাই হোক, সেদিন আবার বাড়তি টাকা গুনে এক টিটির থেকে টিকেট ম্যানেজ করে অন্য ট্রেনে আসলাম।
আলহামদুলিল্লাহ বাসায় ভালোভাবেই পৌছেছি। দুইদিন পর আব্বু বলল তার এক কলিগের মেয়ে আছে, ইন্টারে পরে। তাকে এই চার পাঁচ দিন গিয়ে একটু পড়াশুনার প্রবলেমগুলো সলভ করে দিতে হবে।
ধুর, এই কয়দিনের বন্ধে আসলাম মাত্র, তাও পড়াতে হবে, তাও আবার মেয়ে! ভদ্র ছেলের মতো কথা শুনলাম।
বাসা বেশ দূরেই, যাতায়াত বিরক্তিকর। সেই হালিশহরের বি ব্লকের কোন শেষ মাথায়।
বাসায় এক মহিলা দরজা খুলল, আন্টিই হবে হয়ত। আংকেল ড্রইং রুমেই বসা।
-স্লামুআলাইকুম
-নিশাদ না?
-জ্বী আংকেল
-তো কয়দিনের বন্ধে আসছো?
-এইতো সপ্তাহখানেক আছি আংকেল
-মেডিকেলে তো অনেক পড়ার চাপ, এখানে ভালোমত ছুটি কাটিয়ে যাও
-জ্বী আংকেল
আলাপপর্ব শেষে স্টুডেন্টের রুমে বসার সুযোগ হলো।
ছাত্রী বেশ চালু, অপ্রয়োজনীয় কথা বেশি বলে।
দ্বিতীয় দিন পড়ানোর সময় ছাত্রীর আপু নাস্তা দিতে আসল। আমি তো দেখামাত্রই চমকে গেলাম,
-আপনি!
-আপনি এখানে!
ছাত্রী বললো উনি আমার আপু৷ বুঝলাম যে মানে উনিই সে যে ঢাকা ভার্সিটির জেনেটিক্সে পড়ে, আমার কোরেসপন্ডিং। উনার জন্যই তো সেদিন ট্রেন মিস হলো।
এই মেয়ের প্রতি তো এমনিতেই রাগ জমে আছে, এখন তো চিনে গেছি, দেখি রাগ উসুল করা যায় কিনা।
পড়ানো শেষ, উঠব এখন৷ বাসা থেকে বের হওয়ার সময় ছাত্রীর আপু দরজা লাগিয়ে দিতে আসল, আর আমার হাতে একটা চার ভাজ করা কাগজের টুকরা ধরিয়ে দিল।
বের হয়ে কাগজের ভাজটা খুললাম। একটা ফোন নাম্বার দিয়ে লিখা ‘একটা কল দিবেন’
সেদিন রাতে শুধু একটা টেক্সট করেছিলাম, আপনার ছাতাটা আমার কাছে আছে, সময় করে নিয়ে নিয়েন।
সে টেক্সট পেয়ে ফোনই দিল। রিসিভ করলাম।
-সরি। আপনাকে অনেক ঝামেলায় ফেলে দিছি সেদিন৷ আমি জানতাম না এরকম হবে। সরি। প্লিজ কিছু মনে করবেন না।
-আচ্ছা ঠিক আছে
-কাল পড়াতে আসবেন কখন?
– ৩ টায়। ছাতাটা নিয়ে আসব?
-না, বাসায় আনবেন না, আবার কে কি জিজ্ঞেস করবে তখন এত কাহিনী বলতে পারব না।
-তাহলে?
-আচ্ছা ঢাকা ব্যাক করবেন কবে?
-২৫ তারিখ
-আচ্ছা৷ আমিও তো ২৫ তারিখ যাব। তাহলে আমি দুটো টিকেট কেটে রাখি
-উমম….আচ্ছা
-আর হ্যা, এই টিকেটটা আমি অফার করতেছি, নো টাকা, গতবারেরটা শোধভাত, ওকে?
-আচ্ছা ঠিক আছে।
এরপর আর দুইদিন পড়াতে গেছিলাম শুধু৷ কথা হয়নি, তবে সেই মেয়েটাই নাস্তা নিয়ে এসেছিল, তাও কতগুলো আইটেম নিয়ে। হয়ত সেদিনের ধকলটা খাইয়ে মিটাতে চাচ্ছে।
২৫ তারিখ সকাল সাড়ে ছয়টার মধ্যেই দুজনে স্টেশনে। সুবর্ণ এক্সপ্রেস এখান থেকে ৭ টায় ছাড়ে। উনার ছাতা উনাকে বুঝিয়ে দিলাম। পনের মিনিট আগেই ওয়েটিং চেয়ার থেকে উঠে প্ল্যাটফর্মে ঢুকলাম,
-আপনার হাতে তো দুইটা ব্যাগ, ভারী হয়ে গেছে অনেক, একটা আমাকে দিন, আমি নিচ্ছি
-আপনার কাঁধের ব্যাগ তো কম ভারী মনে হচ্ছে না
-আরে অসুবিধা নেই, দেন এদিকে।
-আচ্ছা নেন
-ওহ ভালো কথা আপনার ছাতা কোথায়?
কথাটা শুনে হেসে দিল,
-আছে৷ ব্যাগের ভিতরে
-যাক আলহামদুলিল্লাহ
-হাহা, এবার কিছু আনতে বলব না, নিশ্চিন্তে থাকেন
-সেটা হলেই ভালো
-আপনি আমাকে তুমি করে বলতে পারেন, ব্যাচমেটই তো….
হাঁটার সাথে কথা চলছে, হয়ত চলবে আরো ঘন্টা ছয়েক, আগে তো ট্রেনে উঠে নেওয়া যাক, চলতে থাকি, এবার ‘ট’ বগি, প্ল্যাটফর্মে একটু বেশি দূরই হাটতে হবে।
লেখক- ফারদিন খান
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ।
Onneeek sundor