২৪ জুন ২০২০, বুধবার
ডা. ফখরুল হাসান
রংপুর মেডিকেল কলেজ ৪১তম ব্যাচ
সবাই যখন বাবা দিবসে ছবি দিচ্ছিলো, আমি তখন বাবার স্যাচুরেশন দেখে সবার ছবিতে লাইক দিচ্ছিলাম আর ওই বদ্ধ কেবিনে দোয়া করতেছিলাম, যেন এই আধার কেটে যায়!
আমি নিজে করোনা নেগেটিভ ছিলাম, কিন্তু বাবাকে ভর্তি করার সময়ে মুচলেকা দিয়ে বাবার সাথে একই রুমে থাকার দরখাস্ত করি। বাবাকে একলা রেখে আসতে মন চায় নি, মনে হইছে এইটাই আমার দায়িত্ব জীবনে। হাসপাতালের সবাই আমাকে দেখতে আসতেছিল, “ভাই, আপনি নেগেটিভ তাও এখানে আঙ্কেলের জন্য থেকে গেলেন? আপনার বাবা তো হাঁটতে চলতে পারে, তাও থাকলেন কেন?”
আমি উত্তরে বললাম, “করোনা তে দূরত্ব বজায় রাখতে হবে কিন্তু ভালোবাসা, দায়িত্ব থেকে দূরে সরে দেওয়া যাবে না।
আমার বাবা, যিনি দুই মাস আগেই IHD নিয়ে CCU তে ভর্তি ছিলেন এবং আগে থেকেই জ্বর ও ডায়াবেটিস ছিল। তিনি সরকারি আইনজীবী তাই নিজ কর্মস্থলে গিয়ে করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন।
সিনিয়র চিকিৎসকদের পরামর্শে বাসায় রেখেই মনিটর শুরু করেছিলাম, কিন্তু হঠাৎ বুকে ব্যথা অনভুব করায় সবাই বলল হাসপাতালে নিতে। বাবা বরাবরই হাসপাতালে যেতে ভয় পায়। সে বলল, “তোর মেডিকেল এ ভর্তি হওয়া গেলে হবো।” আব্বার বরাবরই আমার রংপুর মেডিকেল এর উপরে অগাধ আস্থা। নিয়ে গেলাম বাবা কে রংপুর করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালে।
সারা দেশে যখন চিকিৎসকদের আলাদা হাসপাতাল নিয়ে কতো দাবি আন্দোলন, সেখানে কারো জন্য বসে না থেকে এই হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক স্যার চিকিৎসকদের জন্যে সুন্দর করে কিছু কেবিন তৈরী করেছেন, নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী। যাতে করে কোন চিকিৎসক বা তার পরিবারে কেউ ভালো পরিবেশের অভাব না হয়।
আমি অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে গভীর কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি সেই মানুষ গুলোকে, যারা দিন-রাত খেটেছেন আমার মত একজন ক্ষুদ্র চিকিৎসকের বাবার জন্য। নিজের বাবার মতো আগলে রেখে সেবা করেছেন, খোঁজ খবর রেখেছেন। অধ্যাপক ডা. এ কে এম নুরুন্নবী লাইজু স্যার, যিনি বগুড়া থেকে রংপুর হাসপাতালে নিয়েছেন, কেবিন এরেঞ্জ করেছেন, টেস্ট করিয়েছেন, খাবার পাঠিয়েছেন। একজন অধ্যক্ষ একটা মেডিকেল এর ছাত্রের বাবার জন্য যা করলেন তা অতুলনীয়।
নুরুন্নবী স্যার, যিনি কিনা সারাক্ষণ আঠার মতো লেগে থেকেছেন, বাবার যেন কোন অসুবিধা না হয়। রিফাত ভাই, আপনার এতো এতো ফোন পাইছি বাবার ব্যাপারে, মাঝে মাঝে খুব অবাক হইছিলাম নিজের আত্মীয় এতো খোঁজ নেই কিনা? রাত ১ টায় এক কেস পানি নিজে নিয়ে আসলেন বাবার জন্য।
আর ডিউটি ডক্টর সবার নাম শোনা হয়নি। সবাইকে বলতেছি আপনারা যেভাবে এসে এসে বাবা বাবা বলে আব্বার খোঁজ নিয়েছেন, সেবা দিয়েছেন, আমি নিজেও চোখে পানি আটকাতে পারিনি, আল্লাহ্ সবার ভালো করুক
করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতাল রংপুর
সরকারি হাসপাতালে গিয়ে আব্বার চক্ষু চড়কগাছ, একি দেখছি আমি!
এতো ঝক ঝকে পরিষ্কার হাসপাতাল! বাসায় মায়েরা যেভাবে চকচকে রাখে, তেমনি ঝকঝকে, নার্স ব্রাদার সবাই এগিয়ে আসল বাবা বাবা বলে সবাই সম্মোধন করল, সরকারি হাসপতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স এসে রোগীদের সালাম দিচ্ছে বাবা বলতেছে আমিও খুব অবাক হইছিলাম।
দিনে তিন বার রোগীদের সময় ধরে পুষ্টিকর খাবার আসে, সকল ধরনের ওষুধ বিনামূল্যে প্রদান, এমনকি এন্টিভাইরাল ওষুধ পর্যন্ত নিজ খরচে রোগীদের দেওয়া হচ্ছে।
দিনে চার বার করে সকল রোগীর মনিটরিং, তিন বার করে ক্লিনিং দেখে বাবা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন কিভাবে সম্ভব? নার্স ব্রাদার ক্লিনিং স্টাফরা এতো অমায়িক ব্যবহার সবাই এসে এসে ডাক্তারের বাবার খোঁজ নিচ্ছেন।
আসলে দৃষ্টি ভঙ্গি বদলাতে হবে তবেই সব পরিবর্তন সম্ভব, করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতাল এর তত্ত্বাবধায়কে ডা. নুরুন্নবী স্যার যেন ইতিহাস রচনা করে ফেলেছেন। রোগীর প্রতি স্টাফদের অ্যাপ্রোচ কে উনি চিরাচরিত অবহেলা থেকে বদলে দিচ্ছেন অমায়িক ভালোবাসায়। জঞ্জালে ভরা নোংরা পরিবেশের সরকারি হাসপাতালে ধারনা পাল্টে করেছেন ইউনাইটেড, মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতাল এর মত। সরকারি হাসপাতালে ওষুধ নাই, অক্সিজেন নাই, কিচ্ছু নাই থেকে বদলে দিয়েছেন। এইসব ওষুধ এতদিন ফ্রি ছিল! রোগী দেখা, রাউন্ড দেওয়া, কাউন্সিলিং, পরিছন্নতা পরিদর্শন সব সামলে নিচ্ছেন নিজ হাতে।
রংপুর করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালের এই মহাযজ্ঞ কাজে সামিল আছেন ডা. রিফাত মাহমুদ ভাই, যিনি আরেক পিউর জেম! হাসপাতালকে যিনি নিজের ঘর বাড়ি বানিয়েছেন, যাতে সব কিছু ঠিকঠাক ভাবে চলে। তাঁর সাথে সহযোগিতা করে যাচ্ছেন মোরশেদুল ইসলাম ভাই। আসলে ডেডিকেটেড হাসপাতাল মানেই এতো লেভেল এর ডেডিকেশন, যা লিখতে গেলে দিস্তা খানেক কাগজ লাগবে।
একজন মানুষ অধ্যাপক ডা. নুরুন্নবী লাইজু, অধ্যক্ষ রংপুর মেডিকেল কলেজ, যিনি নিজেকে বিলিয়ে দিচ্ছেন এই করোনা মহামারীকালে সকল চিকিৎসক দের সুরক্ষা, তাদের চিকিৎসা সেবা, তাদের যাবতীয় প্রয়োজনে। এই করোনা ডেডিকেটেড হাসপতালের সকল কিছুই অত্যন্ত দক্ষতার সহিত নানা রকম যুগোপযোগী কাজের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।
কাউকে বলতে পারলাম না একবার গিয়ে ঘুরে আসেন, কিন্তু করোনা হাসপাতালের প্রত্যেক স্টাফ যে ডেডিকেশন দিচ্ছেন, তা শুধু প্রশংসার যোগ্য বলে ভুল হবে, তা আসলে বীর এর কাজ! জাতীয় সম্মানের কাজ! আমার বাবা আজকে সবাইকে স্যালুট জানিয়েছেন। বাবা বলেছেন এরা শুধু যোদ্ধা না, এরা আল্লাহর রহমতের নিদর্শন।
বেঁচে থাকুক আমাদের সবার বাবা, সুস্থ ভাবে।
বেঁচে থাকুক মানবতা।
বেঁচে থাকুক ভালোবাসা সকল স্বার্থের উর্ধে অন্তরের বিশ্বাসে!
একজনের বাবার জন্য আমরা সবাই ঝাঁপিয়ে পড়বো!
ইনশাআল্লাহ!