প্ল্যাটফর্ম সাহিত্য সপ্তাহ -২১
” সোনালি ঈদ “
লেখকঃ
ডা.আল্ – আফরোজা সুলতানা
সিওমেক
২০১১-১২
আমাদের একটা ঈদ ছিল।
চাঁদ রাতে জোনাকিপোকা ধরে ধরে মশারির ভেতর ঢুকিয়ে দিতাম। সেগুলো মরিচা বাতির মত সারারাত জ্বল জ্বল করত আর সেই উড়ন্ত মরিচা বাতি দেখতে দেখতে আমরা কখন যেন ঘুমিয়ে পড়তাম।
খুব সকালে ঘুম ভাঙত পিঠা ভাজার গন্ধে।
সাথে থাকত নারকেল দুধের সেমাই।
সবার আগে গোসল করে বাকি সবাইকে শীত দিয়ে দেয়ার ব্যাপারটা কে মাথায় ঢুকিয়েছিল মনে নেই
কিন্তু সেই অন্ধ বিশ্বাসে হাড়কাপানো শীতে ভাই বোনরা কাপতে কাপতে কে কার আগে গোসল করব তাই নিয়ে হুড়াহুড়ি লেগে যেত।
আর হি হি করে কাঁপতে কাঁপতে হাসতাম “শীত দিসি, শীত দিসি বলে!” ?
এরপর আসত নতুন জামা জুতা।
এর আগে যদি কারো নতুন জামা জুতা অন্য কেউ দেখে ফেলত তাহলে তার ঈদ ওখানেই শেষ।
কেঁদেকেটে সারা বাড়ি মাথায় তুলে ফেলত যতক্ষন না তাকে আরেকটা নতুন কিছু এনে দেয়া হচ্ছে।
মনে আছে সুইটি বুবু একবার সারাদিন ভাত ই খায় নি তার জামা পুরোনো হয়ে গেছে বলে।সারাদিন গাল ফুলিয়ে পেছনের দরজায় বসে ছিল।
আমি অবশ্য বাড়ি এসেই দাদু কে দিয়ে দাদার সিন্দুকে সব পুরে রাখতাম যেন কাক পক্ষীও টের না পায়।
তারপর অপেক্ষা করতাম ছোট কাকা কি আনেন আমাদের জন্য। কখনো মেকাপবক্স, কখনো আলতা, কখনো একটা খয়েরী নেইলপলিশ। ওইটুকু জিনিস পেয়ে মনে হত সাত রাজার ধন পেয়ে গেছি।
সাজুগুজু শেষ এরপর চলত পালা করে সালামি আদায়।
বড় রা কেউ সালামি দেয়া থেকে রেহাই পেত না। যেভাবেই হোক সালাম করতে পারলেই কেল্লা ফতে।
তখন সবাই সালামি দেবার জন্য অনেকগুলো চকচকে ২ টাকা আর ১০ টাকার নোট আগে ভাগেই রেডি করে রাখত। বড়দের জন্য ১০ টাকা, আর ছোটদের জন্য ২ টাকা।
সেই কড়কড়ে ২ টাকার নোটে কি যে সুন্দর গন্ধ!
এখনকার ৫০০ টাকার চেয়ে তখন কার নতুন ২ টাকার নোটের গন্ধ সম্ভবত আরো বেশি আকর্ষণীয় ছিল ।
মেয়ে বলে কেউ ঈদের জামাতে নিত না। রেডি হয়ে ৩ বোন চুপিচুপি বাবা কাকা দের পিছু নিতাম। কিছুদূর যেয়ে ধরা খেলে আবার বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হত। মাঝে মাঝে ফাকি দেয়ার জন্য অন্য রাস্তায় যেয়ে ভুল পথ ঘুরে টুরে মাঠ অব্দি পৌঁছাতে পৌঁছাতে দেখতাম নামায শেষ করে বাবা কাকা রা বাড়ির পথ ধরছেন।
আমরাও তখন বাধ্য মেয়ের মত তাদের পিছু পিছু চলে আসতাম।
তারপর চলত পাড়া বেড়ানো। এমনিতেই কালো ছিলাম তার উপর রোদে পুড়ে চেহারা আফ্রিকান দের মত হয়ে যেত।
মাঝেমধ্যে মা লোক পাঠিয়ে কান ধরে নিয়ে যেতেন। বেশিরভাগ সময় রোদে রোদে ঘুরে জর বাধিয়ে বাড়ি ফিরতাম।
তখন ফ্রীজিং এর যুগ ছিল ন।বড়বড় ডেকচি তে মাংস রান্না হত।
তারপর শেষ হওয়ার আগ পযন্ত যে যত পারো খাও।
তবে আমার প্রধান আকর্ষণ ছিল পরদিন সকালে উঠানে পাটি পেতে চালের রুটি আর মাংসের ঝোল।
এরপর চলত কাকার মাথার পাকা চুল বেছে দেয়ার প্রতিযোগিতা। ১০ টা পাকা চুল ১ টাকা।
আজকালকার যুগে এমন লস প্রজেক্ট এর ব্যবসা কেউ করবে না! ?
দুপুরবেলা সবার ঘর থেকে ১ মুঠ করে চাল, ডাল আর ডিম যোগার করা হত ঝোলাভাতি খেলার জন্য।
বাদ বাকি আলু, মরিচ, পেয়াজ পাশের ক্ষেত থেকেই পাওয়া যেত।
বহু কষ্টে মা চাচী দের থেকে টিপস নিয়ে রান্না করতে করতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল।
কোনরকম বাড়ির খাবার খেয়েই আবার বাড়ির সামনের উঠানে খেলাধুলার জন্য দৌড় লাগাতাম।
ঝোলাভাতির খাবার তোলা থাকত রাতে খাব বলে।
কিন্তু বেশিরভাগ সময় সে খাবার হয় নেঙটি ইঁদুর না হয় বিড়ালের পেটে যেত।
এবং আমরা সেই খাবার খেতে না পারার দুক্ষে ইঁদুর বেড়ালের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করতে করতে মায়ের হাতে ভাত খেয়ে দাদীর কাছে গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে যেতাম।
আমাদের একটা সুন্দর ঈদ ছিল।
কিন্তু দিন গুলো আর সোনার খাচায় রইল না….