স্ক্যাবিস (Scabies) হলো একটি সাধারণ কিন্তু অত্যন্ত বিরক্তিকর চর্মরোগ, যা Sarcoptes scabiei নামক ক্ষুদ্র আকারের পরজীবী মাইটের (mite) আক্রমণে হয়। এটি একটি সংক্রামক রোগ, যা সরাসরি শারীরিক সংস্পর্শ অথবা আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত কাপড়, বিছানা বা তোয়ালে থেকে ছড়াতে পারে। স্ক্যাবিস রোগ বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে এবং এটি সব বয়সের মানুষকে আক্রান্ত করতে পারে।
স্ক্যাবিসের কারণ
স্ক্যাবিসের মূল কারণ হলো Sarcoptes scabiei নামক মাইট। এই মাইটগুলো খুবই ক্ষুদ্র, প্রায় ০.৩ থেকে ০.৫ মিলিমিটার লম্বা, যা খালি চোখে দেখা যায় না।
স্ক্যাবিস মাইট ত্বকের ওপরিভাগে প্রবেশ করে এবং সেখানে ডিম পাড়ে। মাইটের ডিম থেকে লার্ভা জন্ম নেয়, যা পরবর্তী সময়ে পূর্ণাঙ্গ মাইটে পরিণত হয়। এই প্রক্রিয়ার সময় ত্বকে প্রচণ্ড চুলকানি ও ফুসকুড়ি সৃষ্টি হয়।
সংক্রমণ প্রক্রিয়া
স্ক্যাবিস খুব দ্রুত ছড়াতে পারে, বিশেষত যেসব পরিবেশে মানুষের ঘনিষ্ঠ মেলামেশা হয়। যেমন:
১)পরিবারের সদস্যদের মধ্যে।
২) স্কুল, কলেজ বা অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে।
৩) হাসপাতাল বা নার্সিং হোমের মতো জায়গায়।
স্ক্যাবিস সংক্রমণের প্রধান মাধ্যম হলো:
দীর্ঘ সময় ধরে ত্বক-সংস্পর্শ।
সংক্রমিত ব্যক্তি ব্যবহার করা পোশাক, বিছানা বা তোয়ালে ব্যবহার করা।
স্ক্যাবিসের লক্ষণ
স্ক্যাবিসের লক্ষণগুলো রোগীর সংক্রমণের ২ থেকে ৬ সপ্তাহের মধ্যে প্রকাশ পায়। তবে যাঁরা আগে এই রোগে আক্রান্ত হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে লক্ষণ দ্রুত প্রকাশ পায়। প্রধান লক্ষণগুলো হলো:
১. চুলকানি: স্ক্যাবিসের প্রধান লক্ষণ হলো তীব্র চুলকানি, যা সাধারণত রাতে বৃদ্ধি পায়। চুলকানির কারণে আক্রান্ত ব্যক্তি ঘুমাতে পারেন না এবং শারীরিক ও মানসিক অস্বস্তিতে ভোগেন।
২. ফুসকুড়ি: ত্বকে ছোট ছোট গুটি, ফুসকুড়ি বা দাগ দেখা যায়।দাগগুলো সাধারণত আঙুলের ফাঁক, কনুই, কবজি, কোমর, নাভি, স্তনের চারপাশ, এবং শিশুর পায়ের তলায় বেশি দেখা যায়।
৩. টানেল বা সুড়ঙ্গ: মাইট ত্বকের ভেতর দিয়ে চলাচল করার সময় সূক্ষ্ম সুড়ঙ্গ তৈরি করে, যা সরু রেখার মতো দেখা যায়। এই সুড়ঙ্গগুলো সাধারণত আঙুলের ফাঁকে এবং কবজিতে বেশি দেখা যায়।
জটিলতা
স্ক্যাবিস যদি সঠিক সময়ে চিকিৎসা না করা হয়, তবে এটি বিভিন্ন জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।
১) সেকেন্ডারি ইনফেকশন: চুলকানোর ফলে ত্বকে ক্ষত তৈরি হয়, যা ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ ঘটাতে পারে।
২) নোডুলার স্ক্যাবিস: কিছু রোগীর ত্বকে লালচে গুটি (নোডুল) তৈরি হয়, যা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত থেকে যায়।
৩) ক্রাস্টেড স্ক্যাবিস: এটি স্ক্যাবিসের একটি গুরুতর ধরণ, যেখানে ত্বকে পুরু খোসা পড়ে। এটি সাধারণত ইমিউন সিস্টেম দুর্বল রোগীদের মধ্যে দেখা যায়।
স্ক্যাবিসের চিকিৎসা
নিজেকে স্ক্যাবিস আক্রান্ত মনে হলে এমবিবিএস চিকিৎসকের পরামর্শ মোতাবেক ওষুধ সেবন করা জরুরি।
অন্যথায় ভয়াবহ জটিলতার মুখে পড়তে হতে পারে।
প্রতিরোধের উপায়
স্ক্যাবিস প্রতিরোধে নিম্নলিখিত ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে:
১) আক্রান্ত ব্যক্তির চিকিৎসা নিশ্চিত করা।
২) সংক্রামিত ব্যক্তির পোশাক, বিছানার চাদর ও তোয়ালে উচ্চ তাপমাত্রায় ধুয়ে রোদে শুকানো।
৩) পরিবারের অন্যান্য সদস্যদেরও চিকিৎসা নেওয়া উচিত, কারণ স্ক্যাবিস খুব সহজে ছড়াতে পারে।
৪) ব্যক্তিগত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা।
স্ক্যাবিস ও সামাজিক প্রভাব
স্ক্যাবিস শুধু শারীরিক অস্বস্তি নয়, এটি মানসিক ও সামাজিক সমস্যাও তৈরি করতে পারে।
আক্রান্ত ব্যক্তি চুলকানির কারণে জনসমক্ষে যেতে সংকোচ বোধ করেন।
এটি কাজের দক্ষতা কমিয়ে দিতে পারে।
স্কুল বা কর্মস্থলে এটি ছড়ানোর ভয় থাকায় আক্রান্ত ব্যক্তি সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে পারেন।
ক্রাস্টেড স্ক্যাবিস: একটি জটিল রূপ
ক্রাস্টেড স্ক্যাবিস, যা নরওয়েজিয়ান স্ক্যাবিস নামেও পরিচিত, স্ক্যাবিসের একটি গুরুতর এবং সংক্রামক রূপ। এটি সাধারণত এমন ব্যক্তিদের মধ্যে দেখা যায় যাঁদের ইমিউন সিস্টেম দুর্বল।
শিশুদের স্ক্যাবিস
শিশুরা স্ক্যাবিসে আক্রান্ত হলে লক্ষণ কিছুটা ভিন্ন হতে পারে। মুখ, মাথার ত্বক এবং হাত-পায়ের তলায় ফুসকুড়ি দেখা যেতে পারে। তারা অস্বস্তির কারণে অস্থির হয়ে ওঠে এবং ঘুমাতে অসুবিধা হয়।
শিশুদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে বিশেষ যত্ন নেওয়া প্রয়োজন।
বিশ্বব্যাপী প্রাদুর্ভাব
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) মতে, স্ক্যাবিস একটি সাধারণ স্বাস্থ্য সমস্যা, যা উন্নয়নশীল দেশগুলিতে বেশি দেখা যায়। এটি বিশেষত যেসব স্থানে জনসংখ্যা ঘনবসতিপূর্ণ এবং স্বাস্থ্যবিধি নিম্নমানের, সেসব স্থানে বেশি বিস্তার লাভ করে।
উপসংহার
স্ক্যাবিস একটি সাধারণ চর্মরোগ হলেও এর প্রভাব অত্যন্ত অস্বস্তিকর এবং সামাজিক ও মানসিক সমস্যার কারণ হতে পারে। যথাযথ চিকিৎসা এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করলে এটি সহজেই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। ব্যক্তি, পরিবার এবং সমাজের সমন্বিত প্রচেষ্টায় স্ক্যাবিস নির্মূল করা সম্ভব। তাই স্বাস্থ্য সচেতনতা এবং প্রাথমিক চিকিৎসার ওপর গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
প্ল্যাটফর্ম প্রতিবেদক– এস. এম. এম. মুসাব্বির উদ্দিন