ঘটনার শুরু ১৮১৬ সালে প্যারিসের ন্যাকার হাসপাতালে। ফ্রেঞ্চ চিকিৎসক লেনেক (René-Théophile-Hyacinthe Laennec ) তখন সেখানে চীফ ফিজিশিয়ান হিসাবে কর্মরত আছেন। তখনকার দিনে একেবারে রোগীর বুকে কান লাগিয়ে একজন ডাক্তারকে ব্রেথসাউন্ড, হার্টসাউন্ড ইত্যাদি শুনতে হতো, যাকে বলা হয় Immediate Auscultation।
যেখানে এখনকার দিনেও মহিলা রোগীকে এক্সামিন করা অনেকের কাছেই অস্বস্তিকর, সেখানে ওই আমলে এই ব্যাপারটা কতটা অস্বস্তিকর ছিল আমরা ধারণা করে নিতে পারি। এমনই একদিনে একজন স্বাস্থ্যবতী তরুণী হৃদরোগের সমস্যা নিয়ে হাজির হলো লেনেকের কাছে। একে তো তরুণী, তার উপর এই স্বাস্থ্যের জন্য বুকে কান লাগিয়ে ঠিকমত শব্দ শোনা প্রায় অসম্ভব বলে মনে হলো লেনেকের কাছে। কিন্তু তার দেখা বাচ্চাদের খেলার ছোট্ট একটা ঘটনা তাঁকে অন্যভাবে চেষ্টা করতে অনুপ্রাণিত করলো। (দুনিয়ার কোন ঘটনাই হয়তো তুচ্ছ নয়!)
স্কুলের কিছু বাচ্চাকে তিনি কাঠের টুকরা নিয়ে খেলতে দেখেছিলেন একদিন। তাঁদের মধ্যে একজন ফাঁপা কাঠের এক প্রান্তে পিন ঘষে শব্দ করছিল আর অপর প্রান্তে কান লাগিয়ে তার বন্ধুরা সেই শব্দ শুনে মজা পাচ্ছিলো। এই ঘটনাটা মনে হতেই লেনেকের মনে পড়লো, কঠিন মাধ্যমের মধ্য দিয়ে শব্দ প্রবাহিত হলে তা বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়ে অপর প্রান্তে শোনা যায়। এই ব্যাপারটা কি রোগী দেখার ক্ষেত্রে কোনভাবে ব্যবহার করা যায় না? তখনই তার মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। একটা কাগজের নোটোবুক পেঁচিয়ে চোঙা তৈরি করে তার একপ্রান্ত রোগিণীর বুকের উপর আর অপর প্রান্ত কানে লাগিয়ে শব্দ শোনার চেষ্টা করলেন। এতে করে খালি কানে শোনার চেয়েও শব্দগুলো আরও ভালভাবে ধরতে পারলেন!
এরপর তিনি সোজা ওয়ার্ডে চলে গেলেন এবং একে একে সব রোগীকে তার বানানো এই চোঙা দিয়ে পরীক্ষা করে দেখতে লাগলেন।
হাজারখানেক রোগীকে পরীক্ষা করে তিনি মাত্র কয়েকবছরের মধ্যে রোগবিশেষে শব্দগুলোর শ্রেণিবিভাগ করে ফেললেন, সাথে প্রত্যেকটা শব্দের নেচার আলাদাভাবে বর্ণনা করলেন। আজও আমরা যে টার্মগুলো ব্যবহার করি (Rhonchi, Crepitance, Rales, Egophony, etc) এগুলোর অধিকাংশই লেনেকের ব্যাখ্যা করা। তিনিই সর্বপ্রথম Immediate Auscultation এর বদলে Mediate Auscultation ব্যাপারটাকে সবার সামনে আনেন। (যদিও তৎকালীন অনেক বড় বড় চিকিৎসকই এই পদ্ধতিকে মেনে নেননি এবং হাস্যকর-অনির্ভরযোগ্য বলে পরিহাসও করেছিলেন)
পরবর্তীতে কাজের সুবিধার্থে তিনি সবসময় ব্যবহার উপযোগী একটি কাঠের ফাঁপা নল তৈরি করে নিলেন। তার চিরসঙ্গী এই যন্ত্রটার নাম দিতে তিনি গ্রিক দুইটি শব্দ ব্যবহার করলেন। স্টেথোস্কোপ (Stethoscope), “স্টেথো” মানে বুক আর “স্কোপিন” মানে পরীক্ষা করা।
এরপর বিশাল পথ পাড়ি দিয়ে আমরা আজকের দিনের স্টেথোস্কোপ পেয়েছি। ১৮৪০ সালে সর্বপ্রথম Golding Bird এই যন্ত্রে ফ্লেক্সিবল টিউবের ব্যবহারের কথা বর্ণনা করেন। কিন্তু তখনো যন্ত্রটা এক কানেই ব্যবহার করতে হতো। এরপর ১৮৫১ সালে আইরিশ চিকিৎসক Arthur Leared দুই কানে ব্যবহার্য মডেল আবিষ্কার করেন। পরের বছর George Phillip Cammann মডেলটাকে আরও উন্নত করেন। ১৮৫২ সাল থেকে এর বাজারজাত শুরু হয়, এবং এখনো সেই মডেলটাই স্ট্যান্ডার্ড হিসাবে চলে আসছে (প্রায় ১৬৫ বছর আগে বানানো মডেল!!)
১৯৪০-র দশকে Rappaport and Sprague-এর করা একটা স্ট্যান্ডার্ড ডিজাইনের স্টেথোস্কোপ Hewlett-Packard বানাতে শুরু করে, যা ছিল তুলনামূলকভাবে দৈর্ঘ্যে ছোট ও ভারী। পরে ১৯৬০-র দশকে David Littman হালকা এবং আরও উন্নতমানের মডেল তৈরি করেন। সেই থেকে এখন পর্যন্ত স্টেথোস্কোপের একটার পর একটা উন্নত ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহার উপযোগী মডেল বের হয়েই চলেছে! সেসব লিখতে গেলে এখানে মহাকাব্য হয়ে যাবে!
এখন একটু বলি, শেষ পর্যন্ত লেনেকের কী হয়েছিল। তিনি চিকিৎসাবিজ্ঞানে আরও অনেক ক্ষেত্রেই অবদান রেখেছেন। যেমন-
– গ্রিক শব্দ kirrhos থেকে নিয়ে Cirrhosis (সিরোসিস) নামকরণ তারই করা।
– তিনি ফুসুফুসে Melanoma-এর Metastases সম্পর্কেও বর্ণনা করেন।
– তার লেখা A Treatise on the Diseases of the Chest and on Mediate Auscultation বইটি প্রচুর প্রশংসিত।
– তিনি যক্ষ্মা (Tuberculosis) সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা করেন। এছাড়াও এই রোগটিকে ছোঁয়াচে ও এর জন্য একটি বিশেষ কিছু দায়ী বলে মত পোষণ করেন। (যদিও তার এই মতটিকে তখন মেনে নেওয়া হয়নি, উল্টা বিদ্রুপ করা হয়েছিল বলে কথিত আছে। তখনকার দিনে যক্ষ্মার কারণ হিসাবে প্রচলিত ছিল পেটের গোলমাল!!) তবুও তার কাজকে অনেকেই ভিসেলিয়াস, হার্ভে বা হিপোক্রিটাসের কাজের সঙ্গে তুলনা করেছেন।
যাই হোক, যক্ষ্মা নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত তিনিও এই রোগে (MTB) আক্রান্ত হন এবং মাত্র ৪৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে নিয়ে ১৯৪৯ সালে একটা ফ্রেঞ্চ মুভি বানানো হয়েছে (Doctor Laennec)। আমি যদিও এখনো দেখার সুযোগ পাইনি, আগ্রহীরা দেখতে পারেন।
বিস্তারিত লিখতে গেলে অনেক কিছুই লিখতে হয়। সেই ইচ্ছা দমন করে আজ এখানেই শেষ করছি!
ধন্যবাদ।
আদিবা তাসনিম
ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ, সেশনঃ ২০১২-১৩