প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২৫ আগস্ট ২০২০, মঙ্গলবার
প্রতিদিনের পরিশ্রম আমাদের শরীর ও মনে গভীর ছাপ রেখে যায়। প্রতিক্ষণের নানা চ্যালেঞ্জের সঙ্গে বুঝে চলাই জীবন। তবুও, কখনও কখনও শারীরিক সমস্যা বা কোনো দূর্ঘটনা আমাদের জীবনকে ফেলে প্রবল যন্ত্রণায়, ফেলে দুর্ভাবনায়। স্পাইন জনিত সমস্যাগুলি আমাদের প্রায়শই কাতর করে তোলে। আর সে সম্বন্ধে অনেক কিছুই না জানার ফলে, নানা ভুল ধারণার বশে আমরা ভুগতে থাকি আশঙ্কায়।
গত ১৮ অগাস্ট তেমনই একটি ঘটনা ঘটে ১৬ বছরের কিশোরী মীরার (ছদ্ম নাম) সাথে। বৃষ্টিবিলাশ করতে গিয়ে ছাদ থেকে পড়ে স্পাইন ভেঁঙ্গে যায়, তার পরই বুঝতে পারে সে দুই পায়ে শক্তি পাচ্ছে না, কোনো আঙ্গুলও নাড়াতে পারে না, আর কোনো অনুভূতিও পাচ্ছে না। প্রস্রাব পায়খানার কোন নিয়ন্ত্রণ ছিলো না। তারপরই ২০ অগাস্ট তার অপারেশন করে ভাঙ্গা বাঁকা স্পাইন সোজা করা হয়। ডাক্তারগণ বিশেষ দক্ষতার সাথে স্পাইনাল কর্ডের উপর প্রয়োগকৃত চাপ সারাতে সক্ষম হন।
অপারেশন করা হয় ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। অপারেশনের চীফ সার্জন ছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগের রেজিস্ট্রার ডা. মো. ইসমে আজম জিকো। সহযোগী সার্জন ছিলেন ডা. সৈয়দ শাহরিয়ার রাজ্জাক মিমো, ডা. ইফতেখার মারুফ, এ্যানেস্থেশিওলজিস্ট হিসেবে ছিলেন ডা. আশরাফ।
অপারেশনের চীফ সার্জন ডা. মো. ইসমে আজম জিকো অপারেশনটি সর্ম্পকে বলেন,
“রোগীটির অপারেশনে ফ্রি হ্যান্ড টেকনিকে নিখুঁতভাবে স্ক্রু ও রড লাগানো হয়। হাড় ভেঁঙ্গে পায়ের সকল নার্ভের উপর চাপ দেয় ছিল, সেগুলোর চাপ সরানো হয়। ভাঙ্গা হাড়গুলো আবার পুনরায় মোটামুটি আগের অবস্থায় আনা হয়। স্পাইন ভেঙ্গে একদিকে বেঁকে যায় বিশেষ টেকনিকে যন্ত্রের সাহায্যে সেই বাঁকা স্পাইন সোজা করা হয়। রোগীর সর্বশেষ অবস্থা জানা যায়, অপারেশনের পরদিনই অনুভূতি ফিরতে শুরু করে, এখন একটু একটু করে পা নাড়াতেও পারে।”
বর্তমানে বাংলাদেশে স্পাইন সার্জারী অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন,
“বাংলাদেশে নিউরোস্পাইন সার্জারি এখন বিশ্বমানের। ইতোমধ্যেই আমরা সফলতার সাথে অনেকগুলো অপারেশন সম্পূর্ণ করেছি। সফলতার সাথে অনেক মিনিমাল ইনভেসিভ স্পাইন সার্জারী করেছি, প্ল্যাটফর্মে এ নিয়ে আগে বেশ কিছু পোস্ট দিয়েছি।”
আপনার এই সফলতার মূলে কি কি ব্যাপার কাজ করেছে? জানতে চাইলে ডা. জিকো উত্তর দেন-
“এই সফলতা অর্জন করতে আমাদের অনেক বছর ধরে নিবিড় প্রশিক্ষণ করতে হয়েছে সাথে দিতে হয়েছে অনেক সময়, মেধা ও শ্রম। আর এটি সম্ভব হয়েছে বহির্বিশ্বের উন্নত প্রযুক্তির সাথে নিজেকে খাপ খাওয়ানো ও উন্নত দেশগুলোর নিউরোস্পাইন নিয়ে অত্যাধুনিক কাজ, গবেষণা এবং তাদের থেকে জ্ঞান আহরণ করার কারণে। আমরা অনেক দিন ধরে কঠোর পরিশ্রম করেছি, ক্যাডেভার ল্যাবে দিনরাত প্রশিক্ষণ নিয়েছি, মাইক্রোস্কোপ এবং উচ্চ গতির ড্রিল সিস্টেমের দক্ষতা অর্জন করেছি, যার ফলে অনেক জটিল কিন্তু বিশ্বমানের স্পাইন সার্জারি করা সম্ভব হয়েছে।”
নিউরোস্পাইন সার্জন ডা. জিকোর কিছু অত্যাধুনিক অপারেশনের উদাহরণ দিয়ে বলেন,
১) হাড়ের ক্ষয়জনিত রোগে ভার্টিবোপ্লাস্টি/বেলুন কাইফোপ্লাস্টি(বিকেপি)
২) স্পাইন ভেঙ্গে গেলে বা কোন কারণে দুর্বল হলে— না কেটে শুধু ছিদ্র করে স্পাইন ফিক্স করা (পার কিউটেনিয়াস লাম্বার পেডিকল স্ক্রু ইনসারশন এবং এমআইএসএস)
৩) ছিদ্র করে কোন সার্জিক্যাল ইম্প্ল্যান্ট ছাড়াই সারভাইক্যাল ডিস্কজনিত রেডিকুলোপ্যাথির সফল অপারেশন,
৪) ওডোনটয়েড স্ক্রু ইনসারশন
৫) পার কিউটেনিয়াস ভার্টিব্রাল বডি বায়োপসি
৬) ক্র্যানিও ভার্টিব্রাল জংশন স্থিরকরণ ইত্যাদি ।
স্পাইনের সমস্যার উপসর্গ ও লক্ষণগুলি কী কী? এমন প্রশ্নের উত্তরে ডা. জিকো বলেন,
“স্পাইনের সমস্যাগুলি নানাভাবেই দেখা দিতে পারে। সবচেয়ে বেশি যে উপসর্গ দেখা যায় কোমর, ঘাড় ও পিঠে ব্যথা, কোমর ব্যথা পায়ে নেমে যেতে পারে, আর ঘাড় ব্যথা হাতে নেমে যেতে পারে। পায়ের উরুর থেকে নীচের দিকে নেমে আসে আর তখনই হাঁটতে অসুবিধা হয়, হাতে বা পায়ে অবশভাব কিংবা ইলেক্ট্রিক ‘শক’ পাওয়ার অনুভূতি দেখা যায়। মাঝে মাঝে ব্যথা ঘাড়ে হয় সাথে শক্তি কমে যায় আর তখন হাতের সঠিক ব্যবহার করা যায় না যেমন খাবার মুখে তুলে খেতে অসুবিধা, চুল আঁচড়ানো এবং হাঁটাচলা করতে অসুবিধা হয়। ব্যথা কখনও কখনও কম বেশিও হতে পারে। তবে হাত পা যদি দুর্বল হয়ে যায় বা শক্তি কমে যেতে থাকে তখন দ্রূত নিউরোস্পাইন সার্জনের সাথে দেখা করবেন।”
কোন বয়সীদের বেশি হয়, আর কি কারণে এই ব্যথার সৃষ্টি হয়?– এ সম্পর্কে তিনি বলেন,
“সাধারণত সব বয়সী ব্যক্তিই স্পাইনের ব্যথায় আক্রান্ত হয়। এই ধরণের ব্যথার বিভিন্ন কারণ আছে। তবে ব্যথাটি তো অসুখ নয়, অসুখের লক্ষণমাত্র। জীবনযাপনের প্রতিটি কাজেরই এই ব্যথার পেছনে কিছু না কিছু ভূমিকা আছে। দেহের গঠন ও গড়ন, পেশা, জীবনযাপন প্রণালী, বসা বা শোয়ার ভঙ্গি, সবগুলিরই এই ব্যথার উৎপত্তি বা প্রাবল্য অথবা তীব্রতায় কিছু না কিছু ভূমিকা আছে। অধিকাংশ সময়েই এই কারণগুলির ফলে, পিঠের পেশিগুলি কঠিন চাপ সহ্য করতে না পারায় তীব্রতর হয় ব্যথা বা যন্ত্রণার প্রকোপ। আর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঘাড়- পিঠে ব্যথার জন্য কোনো অপরেশন লাগে না। কিছু ওষুধ আর পিঠের পেশি শক্তিশালী করার কিছু ব্যায়াম, কখনও জীবনযাপন প্রণালীতে সামান্য কিছু পরিবর্তন এই ব্যথা নিয়ন্ত্রণে রাখতে যথেষ্ট। তবে কিছু ক্ষেত্রে রোগীর নার্ভ ড্যামেজের ভয় থাকে তখন অপারেশনের পরামর্শ দেওয়া হয়। সাধারণ মানুষের মধ্যে স্পাইন- সার্জারির পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া নিয়ে বেশ কিছু ভুল ধারণা ও আশঙ্কা বহু প্রচলিত। এর পেছনে প্রধান কারণ সঠিক সচেতনতার অভাব এবং গত শতাব্দীর কিছু বিফল প্রয়াস।”
বাংলাদেশে নিউরোস্পাইন সার্জারীর ভবিষ্যৎ কি? জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন-
“এন্ডোস্কপিক স্পাইন সার্জারীতে বহির্বিশ্বের চেয়ে বেশ পিছিয়ে আছি আমরা। কাজ যখন শুরু করেছি তখনই করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে আর এগােতে পারিনি। তবে খুব দ্রুত আমরা ভালো অবস্থানে পৌঁছাব।