প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ৯ আগস্ট ২০২০, রবিবার
ডা. জুহায়ের আহমেদ
এমবিবিএস (ডিএমসি), এমপিএইচ (হেল্থ ইকোনমিক্স), এমএসসি (পাবলিক হেল্থ ইন্টেলিজেন্স), শেভেনিং অ্যালুমনাস, ফরেন ও কমনওয়েলথ অফিস, যুক্তরাজ্য।
এমবিবিএস পাশ ডাক্তার সাধারণত ২০-২৪ হাজার টাকা প্রতি মাসে বেতন পান বাংলাদেশে। এই বেতন আমাকে কখনোই আকৃষ্ট করেনি। পালানোর কোন পথও আমি দেখতে পাচ্ছিলাম না। প্রথম জব ইন্টারভিউ দেই একটা মাল্টিন্যাশনাল বায়োমেডিকেল কোম্পানিতে। তৎকালীন হোটেল শেরাটনে ইন্টারভিউ হয়েছিল। যেকোনো ইন্টারভিউতে আমার অভিগমন খুব সহজ- সর্বাবস্থায় সত্য কথা বলা। সন্তুষ্ট করার জন্য মিথ্যা আমি বলি না। বায়োমেডিকেল কোম্পানিতে বলেছিলাম টাকাটা এমআরসিপি দেয়ার জন্য দরকার। এই বয়সেও বাবার টাকা খেতে লজ্জা লাগে। সিলেক্টেড হয়েছিলাম, যাইনি আর। কারণ লেখাপড়া বিসর্জন দিয়ে কোনো চাকরিতে যাওয়া টা বরাবরই আত্মঘাতী মনে হয়েছে আমার। ওদের শর্তটা ওরকম ছিলো কিছুটা।
এরপর গেলাম একটা ভিন্ন ধারার স্বাস্থ্য সংস্থায়। ইন্টারভিউ বোর্ডে জিজ্ঞেস করলো সামনে তো এফসিপিএস পার্ট-১ তোমার, মাত্র এক সপ্তাহ আগে ইন্টার্নশীপ শেষ করেছো! তো পরীক্ষায় ক্ষতি হবে না? বলেছিলাম, পরীক্ষার জন্য ৬ বছর পড়েছি, পার্ট-১ শুধু এই ক‘দিনের চেষ্টায় কেউ পাশ করতে পারে না। আগের কষ্টগুলোই পাশ করার জন্য যথেষ্ট। চাকরিটা পেয়েছিলাম। কিন্তু ক‘দিন পরেই যখন ছাড়তে গিয়েছিলাম তখন এমডি বলেছিলেন-
“আমরা জানতাম তুমি থাকবে না। তবুও কেন যেন ইচ্ছে হলো আমার জামাইর। ও তোমাকে জোর করে নিয়েছিলো। আমি তখনো বুঝিনি উনাদের কেন মনে হয়েছিল আমি থাকবো না। কারণ চাকরির বাজারে আমার দাম সম্পর্কে ধারণা তখনো হয় নি! আমার দৃঢ় বিশ্বাস, বেশিরভাগ ডাক্তারেরই এই ধারণা থাকে না”।
আর সেই সুযোগে ঢাকা শহরের একজন ভিক্ষুকের আয়ের সম পর্যায়ের বেতন হাসপাতালগুলো দিয়ে থাকে এবং তাতেই খুশি মনে সব ডাক্তার রাজী এবং গর্বিত হতে থাকে! অথচ রোগীকে কিন্তু আকাশচুম্বী পয়সা খরচ করতে হচ্ছে যেটা তার ধারণা ডাক্তারের পকেটেই সিংহভাগ যায়! সরকারী হাসাপাতালেও প্রচুর অনাচার দেখতে হত। যেমন- একটা খুব সচরাচর ঘটনা ঢাকা মেডিকেলের ইমারজেন্সীতে ঘটত। রোগীকে অপারেশন করে বা দরকারি চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেয়ার পরেই দাদুরা (ওয়ার্ড বয়+ আয়া) এক কোণে নিয়ে যা বলতো তার ধরণটা মোটামুটি এমনঃ
-ডাক্তারের ফিস দেন। -কত? -দেন যা দিবেন ১০০০, ২০০০ যা দেন!
-ডাক্তাররে তো সরকার পয়সা দেয়! টিকেট কেটে আসছি! তাইলে আবার দিবো কেন?
-আরে বুঝেন না! এগুলা নতুন হইলে কি হইবো? কসাইর মতো লোভ! মইরা গেলাম যন্ত্রণায়!
রোগী এবার মোটামুটি কনভিন্সড। একজন লোভের শিকার নির্যাতিত গরীব মানুষকে তো পয়সা দেয়াই যায়! সরকারী হাসপাতালে যত জনের কাছে এমন টাকা দিয়ে থাকেন, সব ১০০% ফ্রি এবং ওই লোকগুলো নিজেরা এভাবেই জীবন ধারণ করে। মাঝখান দিয়ে ডাক্তারের নামে কালিমা লেপন করে দিয়ে যায়! আমাদের দোষ এখানে দুটো-
১. এসব পাবলিককে ব্যাখ্যা করে বুঝাই না।
২. দায়িত্বশীলদের হাতে প্রমাণসহ এদের কীর্তি দেখিয়ে সিস্টেমটা বদলাতে সচেষ্ট হই না।
পুরো মেডিকেল সেক্টরেই ডাক্তারের নাম ভাঙিয়ে কতজন যে পয়সা নেয় তার ইয়ত্তা নেই। সহজ- সরল বাঙালি আমরা তাতেই বিশ্বাস করি। কারণ নাম ভাঙিয়ে খাওয়া লোকগুলো আপনার আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে, আপনার মত করেই চটুল কথা বলে, আপনার মতো সাধারণ বেশ-ভূষা নিয়েই চলে কিন্তু তারাই ঠকায়। নতুন হওয়া ঐ ডাক্তারের মন এখনো সম্পূর্ণ পবিত্র, মাথায় রাজ্যের চিন্তা আর হৃদয়ে তারুণ্যের উত্তেজনা। আপনাকে ঠকিয়ে খাওয়ার মত ইচ্ছে বা সুযোগ কোনটাই তার নেই, যা দেখা যায় তার পিছনেও একটু তাকানো উচিৎ। সেদিন দেখলাম মাসিক ১৬০০০ টাকা বেতনে একটা হাসপাতালে ডাক্তার নিয়েছে, যাকে আবার প্রথম ২ মাসের বেতন দেয়া হবে না! তাতেও সেই ডাক্তার খুব সন্তুষ্ট এমবিবিএস এর পিছনে তার অনেক খরচ হয়েছে তাই! কাল থেকে দেখছি এক হাসপাতালের এমডি অত্যন্ত বাজে আচরণ করেছে এক ডাক্তারের সাথে! এগুলো বহুদিন ধরে চলে আসা ট্রেন্ডের অংশ। সাথে হুমকি, লাঞ্ছনা ও নিরাপত্তাহীনতা তো আছেই! গত কয়েক বছরে নারী চিকিৎসকরাও রেহাই পায়নি এদের হাত থেকে! দেশের মানুষ একটু নরম- সরম দেখলে বাজিয়ে দেখবেই! শক্ত মানুষের সাথে যে এরা পারে না! সাথে আছে ‘পাশের বাসার আন্টি‘ এর মতো একই লেভেলের বুদ্ধি আর চিন্তাভাবনা সর্বস্ব সাংবাদিকগুলো। প্রশিক্ষণবিহীন চাকরির ভয়ংকর কিছু উদাহরণ! হাসপাতালে চাকরি শুরুর ৩ মাস পরেই নানা কারণে বুঝে গিয়েছিলাম দেশে থাকলে ক্লিনিক্যালে থাকা আমার চলবে না। অবনতি হতে হতে জুনিয়র ডাক্তারদের কসাইখানা হয়ে গেছে ওগুলো! সিদ্ধান্ত নিতে তাই দেরী করিনি। তবে “স্বজাতির ভোগান্তি দেখলে খারাপ লাগে, ভীষণ খারাপ লাগে!”