আজ থেকে তিন বছর আগের কথা।পরদিন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা। বাসে চড়ে যাচ্ছিলাম। অবশ্য তখন আমি জাহাঙ্গীরনগরের চলতি শিক্ষাবর্ষের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের ১ম বর্ষের ছাত্র।আর একটু ভালো Subject এর আশায় ২য় বার ভর্তি পরীক্ষা দিতে যাচ্ছি।হঠাৎ কলেজের ছোট ভাই মেহেদীর ফোন।ফোনের রিসিভারটা ক্লিক করতে গিয়ে হাত ঠক ঠক করে কাঁপতে শুরু করল,ফোন কানে নিতেই মেহেদীর চিৎকার,
“ভাইয়া,আপনি মেডিকেলে চান্স পেয়েছেন!সলিমুল্লাহ মেডিকেল।”
নিজের কন্ঠটার ভলিয়ম অনেক বেড়ে গেল,
“সত্যি বলছিস? আমি মেডিকেলে চান্স পেয়েছি!”
বাসের আশেপাশের সীটের মানুষ গুলো অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আমার দিকে।আমি তখন আমার কাছের মানুষদের ফোন করে সুখবরটা দিতে শুরু করলাম।ততক্ষনে চলমান বাসের সবার কাছে আমি একজন নায়কের মত চরিত্রে পরিণত হয়েছি।এক বৃদ্ধ তার বুড়িকে দেখিয়ে দিচ্ছে,”ঐযে, ঐ ছেলেটা, মেডিকেলে চান্স পেয়েছে, এই ছেলে তুমি মেডিকেলে চান্স পেয়েছো না? দোয়া করি ভালো ডাক্তার হও।”
তার কথা শেষ না হতেই আমার সামনের সিটের এক দম্পতি আমাকে ডাকল।
দেখে মনে হচ্ছে, বছর দুয়েক আগে বিয়ে করেছে। বউটার কোলে ফুটফুটে একটা বাচ্চা।
আমাকে বলল, “বাবা আমার ছেলেটাকে একটু দোয়া করে দাও, সে যেন বড় হয়ে তোমার মত ডাক্তার হয়।”
বাচ্চাটির মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম|
পাশের সীটের দুইজন কলেজ পড়ুয়া মেয়ে বলল,“ভাইয়া ভাইয়া,আপনি মেডিকেলে চান্স পেয়েছেন?”
তাদের ঠোঁটের কোণে অবাক হওয়া মিষ্টি হাসি দেখে কিছুক্ষনের জন্য নিজেকে হারিয়ে ফেললাম।তাদের পেছনের সিট থেকে এক মধ্য বয়স্ক মহিলা তার কিশোর ছেলেকে বলে উঠল, “ঐযে দেখছ ভাইয়াটাকে, তোমাকেও কিন্তু ওর মত ডাক্তার হতে হবে।বাবা, আমার ছেলেকে একটু বলতো কিভাবে পড়তে হয়।”
আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম আরো অনেক উৎসুক মানুষ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।একজন মায়ের চোখ জ্বলজ্বল করছে, একজন বাবার মুখে গর্বের ছাঁয়া, যেন আমিই তার ছেলে, দুইজন কিশোরী মেয়ের চঞ্চল খুনসুটি, বাসের হেলপারের অদ্ভুত শ্রদ্ধা।হঠাৎ বাড়ি থেকে মায়ের ফোন,”বাবা তুই বাড়ি আয়,জাহাঙ্গীরনগর আর গিয়ে কি করবি?”মাকে বুঝালাম,”যাচ্ছিলাম যখন যাই, বন্ধুদের সাথে দেখা করে আসি।”
অনেক স্মরণীয় একটি বাস ভ্রমন শেষে বাস থেকে নেমে আসতে খুব কষ্ট লাগছিল।কারণ ঐটুকু সময়ে বাসের সবাই আমার খুব আপনজনে পরিনত হয়েছিল। এক দাদু বাস থেকে নামার আগে আমার মাথায় হাত রেখে দোয়া করে দিল, এক মা তার ব্যাগ থেকে অনেকগুলো চকলেট বের করে দিল।একজন বাবা আমাকে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিল। কি যে আনন্দের ছিল সেই সময়টুকু তা হয়ত বোঝাতে পারবো না লিখে।
যখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছালাম,তখন গিয়ে দেখি কিভাবে যেন আমার বন্ধুরা আগেই খবর পেয়ে গেছে।তাদের আনন্দ দেখে মনে হচ্ছিল তারা সবাই যেন আমার নিজের ভাইবোন,বন্ধুদের মধ্যে যে এত আনন্দ তা আগে কখনো অনুভব করিনি আমি।যে ছেলেটির সাথে আগে কখনো কথা হয়নি আমার,সে এসে বলল,
“চল দোস্ত, আজ সারারাত আড্ডা হবে।”বন্ধুদের সাথে একটা জমপেশ আড্ডা হল সেদিন রাতে।উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের আরো যারা চান্স পেয়েছিল মেডিকেলে তাদেরও অনেকে উপস্থিত হল তার পরদিন। দুদিন অন্যরকম একটি মূহুর্ত কাটিয়ে,নিজের কাগজপত্র বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উঠিয়ে নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলাম!মা বাবা তো ততক্ষনে বাড়ি আয়, বাড়ি আয়, বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে উঠেছে।
বাড়ি গিয়ে যখন মায়ের সাথে প্রথম দেখা হল তখন মায়ের মুখের এক চিলতে হাসি দেখে মনটা ভরে গেল। লেবু আর করমচার পাতায় শেষ বিকেলের সূর্য যখন একটু মিষ্টি রোদ ছড়িয়ে দেয়, তখন তার একটুখানি ঝিলিক যেমন স্বর্ণের হাসির মত লাল-সাদা করমচা আর সবুজ লেবুর কচি সবুজ পাতায় জ্বলজ্বল করে জ্বলে, ঠিক তেমনই মায়ের সেই হাসিটুকু ছিল আমার জীবনের সব চেয়ে বড় পাওয়া!আর তখনই বাবার কথা
-তোমার জন্য একটা টুকটুকে ডাক্তার বউ এনে দেব!
কি অদ্ভুত!
ডাক্তার না হতেই বাবার মাথায় তার ছেলের জন্য টুকটুকে ডাক্তার বউয়ের চিন্তা।যদিও বাবার কথাটা শুনে মনে মনে খুব খুশি হয়েছিলাম।সব কথার ভীড়ে যে কথাটি কখনো বলা হয়নি তা আজ বলে গেলাম, মেডিকেলে চান্স পাওয়ার পর মায়ের সেই হাসির কথা।বাবার সেই টুকটুকে ডাক্তার বউয়ের কথা।বাসের মধ্যে সেই সুন্দর স্মৃতির কথা।আর গ্রামের সেই বৃদ্ধটি যে কিনা গ্রামে গেলেই আমাকে ডাক্তার নাতি বলে ডাকে,তার কথা।সেই সব মানুষদের শ্রদ্ধার কথা মনে করে
মেডিকেলের সব কষ্ট,সবার কসাই ডাক,আর বিত্তবানদের অবজ্ঞা ভুলে গিয়ে বুক উচিঁয়ে বলতে চাই…
I am a medical student
A proud medical student
প্ল্যাটফর্মের প্রথম সঙ্খ্যার জন্য লিখেছিল স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের রেজওয়ান শুভ । মেডিকেল কলেজের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের মেডিকেল লাইফের প্রথম ক্লাস হয়ে গেল গত কাল, তাঁদের জন্য নতুন করে শেয়ার দিলাম । কমেন্টে প্ল্যাটফর্ম পত্রিকার প্রথম সঙ্খ্যার ডাউনলোড লিঙ্ক । চতুর্থ সংখ্যা বের হচ্ছে একুশের বই মেলায় ।
এ লেখাটি যদি এ বছর নতুন ফার্স্ট ইয়ারের কেউ পড়ে থাকেন একটু কমেন্টে বা ইনবক্সে আওয়াজ দিতে অনুরোধ করছি ।