প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ৭ মে ২০২০, বুধবার
আমেরিকার ‘সেন্টার ফর ডিজিস ডিনামিক্স, ইকোনমিক্স ও পলিসি’ এর মতে, ভারতের উচিত এখন পুল পরীক্ষার উপর জোর দেয়া। যাতে গুচ্ছ চিহ্নিতকরনের মাধ্যমে রোগের বিস্তার বোঝা যায়।
ডা. রামানন লক্ষ্মী নারায়ণ রিপোর্টারকে বলেন যে,
“মহারাষ্ট্র ও তালিমনাড়ু এই দুই অঞ্চলের নমুনা পরীক্ষার ফলাফল পর্যবেক্ষণ করে ধারনা করা হচ্ছে যে, কোভিড-১৯ জুলাই এর শুরুতে শীর্ষে থাকবে।”
প্রশ্নঃ আমরা লকডাউন ৪.০ তে আছি, এবারে পরিস্থিতি কিভাবে বিস্তৃত হবে?
“সত্য উত্তর হচ্ছে, আমি জানিনা।
যখন লকডাউন ছিল না, তখন আমরা করোনা ভাইরাস সংক্রমণের প্রেডিকশন মডেল তৈরি করতে পেরেছি। কিন্তু লকডাউন থাকা অবস্থায় আমরা ভাইরাসের গতিপথ জানি না। কারন ভারতে মহামারী এক অঞ্চলে সীমাবদ্ধ নয়। এখানে মহারাষ্ট্র মহামারী, গুজরাট মহামারী, তামিলনাড়ু মহামারী ও দিল্লী মহামারী আছে। এবং প্রকাশিত তথ্যর ভিত্তিতে এমন কিছু প্রদেশ রয়েছে, যেখানে বাস্তবিক অর্থে এখনো মহামারী শুরু হয়নি, যেমন- ইউপি, বিহার, ঝাড়খণ্ড, এবং ছত্তিসগড়। আপনি যদি মহারাষ্ট্র ও তামিলনাড়ু থেকে পাওয়া তথ্য গুলো পর্যালোচনা করেন, তাহলে দেখা যায় যে সেগুলো জুলাইতে ভারতে কোভিড-১৯ শীর্ষে থাকার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
কার্ভের আকার অনুযায়ী এটাই ধারনা করা হচ্ছে যে, জুলাই এর শুরুতে কোভিড-১৯ শীর্ষে থাকবে। কিন্তু আমরা একদম নিশ্চিত নই। এখানে মূল সমস্যাটা হচ্ছে আমাদের পরীক্ষা কম করা হচ্ছে এবং আমরা সকল সংক্রমিত রোগীকে চিহ্নিত করতে পারছি না। আমরা এটাও নিশ্চিত করে বলতে পারি না যে, আমরা যে তথ্যর ভিত্তিতে করোনা রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ও মৃতের একটি প্রেডিকশন তৈরি করছি, সেই তথ্যগুলোই বা কতটুকু সঠিক। এই মডেল গুলো নিয়ে আরও একটা ব্যাপার মাথায় রাখতে হবে যে, পরবর্তীতে তথ্য প্রাপ্তির উপর ভিত্তি করে সময়ের সাথে এটি কিভাবে পরিবর্তন হবে। আমাদের সমস্যা হচ্ছে, ভারতের মত বিরাট জনসংখ্যার দেশে আমরা যদি প্রতিদিন এক লক্ষ পরীক্ষাও করি তাও সেটা যথেষ্ট নয়।”
প্রশ্নঃ কারো কারো মতে, ভারতে প্রত্যেকের পরীক্ষা করার প্রয়োজন নেই। কারন পরীক্ষার হারের সাথে সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা বাড়েনি!
“এটা আসলে ঠিক নয়। কারন সরকার কেবল পরীক্ষার সংখ্যা প্রকাশ করে, রোগীর সংখ্যা প্রকাশ করে না। এমনকি কত গুলো নতুন নমুনা পরীক্ষা হয়েছে সেটাও প্রকাশ করে না। বরং একত্রে কত গুলো নমুনা পরীক্ষা হয়েছে তার সংখ্যা প্রকাশ করে। যার মধ্যে হাসপাতাল থেকে ছাড়া প্রাপ্ত রোগীর নমুনাও আছে। তাই যখন অনেক মানুষ সুস্থ হয়ে যাচ্ছে এবং এই সুস্থ ব্যক্তিদের প্রত্যেকের যদি দুইটা করে নমুনা নেয়া হয় আর সেগুলো নেগেটিভ হয় তাহলে স্বাভাবিক ভাবে আপনার পরীক্ষার সংখ্যা বাড়বেই।
অন্য দেশ গুলো যেভাবে পরীক্ষা করছে তা হল, তারা বিস্তৃত জনসংখ্যার উপর পরীক্ষা করছে এবং তাদের পজিটিভ রোগীর সংখ্যা তাদের পরীক্ষার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।”
প্রশ্নঃ আমাদের কি উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ [রেড জোন] এলাকা গুলোর দিকে বেশি মনযোগী হওয়া উচিত? সেক্ষেত্রে আমাদের কৌশল কি হওয়া উচিত মনে করেন?
“প্রথমত, আমাদের পুল হিসেবে পরীক্ষা করে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা গুচ্ছকে [ক্লাস্টার] চিহ্নিত করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, প্রত্যেককে পরীক্ষা করে পজিটিভ হলে তাদেরকে কোয়ারেন্টাইন করা। যদিও এই প্রক্রিয়ায় কাজ করার সময় চলে গিয়েছে। এছাড়া আমরা আমাদের পরীক্ষা করার ক্ষমতাও এক লক্ষ থেকে ১০ লক্ষ করতে পারছি না। আমার মনেও হয় না ভারতের এটা করার সামর্থ্য আছে। আমাদের এখন যেটা করতে হবে তা হল, মৃত্যুর সংখ্যা হ্রাস করা। সে জন্য ষাটোর্ধ সকলের যাদের উপসর্গ আছে তাদের পরীক্ষা করতে হবে। কোভিড-১৯ এর চিকিৎসা সুবিধা সম্পন্ন হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে এবং প্রথম দিন থেকেই সঠিক চিকিৎসা দেয়া শুরু করতে হবে যাতে তারা মৃত্যুবরণ না করেন।
নমুনা পরীক্ষার পরিমাণ বা সংখ্যা মহামারীর বিস্তৃতি নির্ধারণের জন্য প্রধান পন্থা হবে না। বরং মৃতের সংখ্যা দ্বারা মহামারীর গতি-প্রকৃতি ও বিস্তৃতি নির্ধারিত হবে। এপিডেমিওলজিকাল মডেলের মাধ্যমে এটি করতে হবে। কিন্তু আমাদের সেই সামর্থ্য এখন নেই। তাই বর্তমান অবস্থা বিবেচনায় আমাদের পরীক্ষার মাধ্যমে মানুষের জীবন বাঁচাতে হবে।”
প্রশ্নঃ তাহলে আপনি বলতে চাচ্ছেন যে, আমাদের প্রচুর পরিমাণে পরীক্ষা করা প্রয়োজন?
“পরীক্ষার পরিমান অবশ্যই বৃদ্ধি করতে হবে কিন্তু এর সাথে এটাও বলছি যে, আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা কেবল মাত্র ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলো টার্গেট করে করা ঠিক হবে না। এই সংক্রমণ এত দ্রুত ছড়াচ্ছে, এটা ভাবা ভীষণ বোকামি যে, আজ যেখানে রোগী নেই কাল সেখানে রোগী থাকবে না।”
প্রশ্নঃ আপনি কি বলতে চাচ্ছেন যে, যে সব এলাকায় এখনও রোগী পাওয়া যায়নি সেটা এই জন্য যে, সেখানে যথেষ্ট পরিমান পরীক্ষা করা হয় নি বলে?
“মহামারীর এই অবস্থায় আমি খুবই অবাক হবো, যদি ভারতের একটি নির্দিষ্ট এলাকায় কোন রোগী পাওয়া না যায়। হয়ত দক্ষিন-পুর্বাঞ্চলের কিছু এলাকা আছে। কিছু আমাদেরকে সেই দিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে। কেননা ভাইরাস খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে।”
প্রশ্নঃ সরকারের মতে লকডাউনের কারনে সংক্রমনের হার কমে গিয়েছে। কেননা দ্বিগুন হারে সংক্রমণের পর্যায়টি কমে গিয়েছে। আপনার কি মনে হয় আমরা আবার এর পুনরুত্থান দেখতে পাবো?
“লকডাউনের কারনে অবশ্যই মহামারীর গতি কমে গিয়েছে। কিন্তু একটা সময়ের পর এটা আর কার্যকরী হবে না। আমার মনে হয় প্রথম ২১ দিনের লকডাউনের কার্যকরী ছিল এরপর আবার ১০ দিনের লকডাউন ও কিছুটা উপকারি ছিল। কিন্তু ২০ দিনের পর আর লকডাউন কার্যকরী হচ্ছে না এটা কেবল মহামারীর গতিকে আটকে রেখেছে। আমরা লক ডাউন তুলে নেয়ার পর পরই করোনা সংক্রমণ এর পুনরুত্থান দেখতে পাবো। কারন এটাই এই রোগের ধরন। আপনাকে মনে রাখতে হবে যে, লকডাউন এর উদ্দেশ্য এই নয় যেন মহামারী চলে যায়।”
প্রশ্নঃ সবাই বলছে এই ভাইরাসের সাথেই জীবনযাপন করতে হবে। আমরা কিভাবে একটা ভাইরাসের সাথে জীবনযাপন করবো?
“আমার মনে হয় সরকার যত কিছুই করুক, একটা সময় পর ভাইরাস নিজের মত করেই ছড়াবে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, আমাদেরকে এই ভাইরাসকেও সমীহ করতে হবে। কেননা এই ভাইরাসই রোগের সময় রেখা নির্ধারণ করবে। এই ভাইরাসের বিপক্ষে আমাদের যে একটা হাতিয়ার আছে তা হল সামাজিক দূরত্ব। এবং যেহেতু সামাজিক দূরত্ব পালন স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে হচ্ছে না, তাই আমাদেরকে লকডাউন দিতে হয়েছে। এই লকডাউনের পরেও আমাদের সামাজিক দূরত্ব মেনে চলতে হবে যেভাবেই হোক। বিষয়টা এক কথায় বললে জনগণ এর নিয়তি জনগণ এর হাতে।”
প্রশ্নঃ রোগের দ্বিতীয় পর্যায়ের ব্যাপারে ব্যাপক আকারে আলোচনা হচ্ছে, আপনার মতে এই দ্বিতীয় পর্যায়ের কারন কি?
“এই মহামারী সমুদ্রের ঢেউয়ের মত। তাই এটি নির্ভর করে কত গুলো ঢেউ আছে তার উপর। যদি খুব দ্রুত চলে তাহলে ঢেউ অনেক বড় হবে। তারপর এটি তীরে এসে শেষ হয়ে যাবে। এই রোগের ক্ষেত্রেও একটি বড় ঢেউ উঠেছিলো এবং শেষ হয়ে গিয়েছে বা যাচ্ছে। একই ভাবে যদি সংক্রমণ সংখ্যা বিভিন্ন পর্যায়ে নিয়ন্ত্রণ না করা যায়, রোগীর সংখ্যা বাড়ে, তাহলে মহামারীর একটার পর একটা ঢেউ আরও উঁচু হয়ে আছড়ে পড়বে এবং সমাজ আর অর্থনীতিকে লণ্ডভণ্ড করে ফেলবে। এই কারনেই আমরা চাচ্ছি সংক্রমণের হার কমিয়ে ফেলতে যাতে করে রোগের পর্যায়ের পরিমান বড় না হয়। আপনি যদি এই রকম আরটি ছোট পর্যায় পান তাহলে আমরা সেটাকে দ্বিতীয় পর্যায় বলব কারন এখনও অনেক মানুষ আক্রান্ত হয়নি।
আমার মতে একটা বড় পর্যায়ের চেয়ে দুই তিনটা ছোট পর্যায় হওয়া ভাল। আমরা এখনও একটা পর্যায়ের পুরোটা দেখি নাই, একটি পর্যায়ের মধ্য আছি। এটি এখনও গতি তৈরি করছে। এবং যেহেতু প্রথম পর্যায়টি এখনও শেষ হয়নি, তাই এই বিষয়ে বলার মত সময় এখনও হয়নি। এছাড়াও এই বিষয়টি লকডাউন ও রোগ নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতির উপর নির্ভরশীল।”
প্রশ্নঃ ভাইরাসটি কেন কোন কোন অঞ্চলে মারাত্মক রূপ ধারন করেছে; যেমন- পশ্চিম বাংলা, মহারাষ্ট্র, বা দিল্লী এবং এসব এলাকাই সংক্রমিত জনসংখ্যার পরিমান বৃদ্ধি করেছে?
“এর জন্য বিভিন্ন বিষয় কাজ করে; যেমন- কিছুটা সময়ের উপর নির্ভর করে, সংক্রমিত এলাকার জনসংখ্যার উপর নির্ভর করে ইত্যাদি। মহারাষ্ট্রে, মূলত মুম্বাই একটি অতিরিক্ত জনবহুল শহর। আপনি যদি জানতে চান কেন দিল্লী, মুম্বাই, গুজরাট, তামিলনাড়ুতে কারোনা সংক্রমণ বেশি, আমি বলব এই শহর গুলোতে আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর আছে। ফলে দেশের বাইরে থেকে যারা এসেছেন তারা এই স্টেটগুলোতে এসেছেন। আবার যেহেতু পাটনাতে কোন আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর নেই, সেখানে সংক্রমনের পরিমান ও কম। তাই এই ভাইরাসটি যে শহর গুলো দিয়ে ভারতে এসেছে সেখানেই মহামারী অগ্রসর করেছে। এই কারনেই এই স্টেট গুলোতে মহামারী অন্য স্টেট গুলো থেকে এগিয়ে আছে। আপনি একটা স্টেটের সাথে আরেকটার তুলনা করতে পারবেন না। কেননা এদের প্রত্যেকের একটি নিজস্ব কার্ভ রয়েছে এবং প্রত্যেকেই নিজের নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করছে।”
প্রশ্নঃ ভারত কি মহামারীর মঝারি মানের তীব্রতা অনুভব করছে? এখানে কি ভাইরাসটি অন্য জায়গার চেয়ে পরিবর্তিত আচরণ করছে?
“রোগ প্রতিরোধ প্রক্রিয়ায় কোন পরিবর্তন নেই। শুধু মাত্র আমাদের এখানে মহামারীটি দেরিতে এসেছে। পাকিস্তান, ভারত, বাংলাদেশ এই দেশ গুলোতেও এই মহামারী একটু দেরীতে এসেছে এই যা। মনে রাখতে হবে, কোন এক সময়ে বিশ্বের সংক্রমণ তালিকায় আমরা ৩৯তম ছিলাম। কিন্তু আজকে আমরা সংক্রমণের পরিমাণে চায়নাকেও ছাড়িয়ে গিয়েছি। তাই আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি, এই ধরনের কিছু বলা না। এটা হচ্ছে দেশগুলো তাদের লকডাউনের পরবর্তী পর্যায়টি কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে, সেই পদ্ধতির উপর নির্ভরশীল। ভাইরাস থেকে বাঁচার কোন একটি বিশেষ পদ্ধতি নেই। কেউই এই ভাইরাস থেকে নিরাপদ নয়।”
প্রশ্নঃ বর্ষা শুরুর সাথে সাথে গরম আবহাওয়া কি এই অবস্থার কিছুটা উন্নতি করবে? নাকি আরও বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলবে?
“ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়ার ক্ষেত্রে গরম আবহাওয়া কোন সুবিধা দিবে না। তামিলনাড়ুতে অনেক রোগী পাওয়া গিয়েছে। সারা ভারতেই গরম আবহাওয়া যুক্ত ষ্টেটে সংক্রমণের হার বেশি। এখন পর্যন্ত আবহাওয়া সংক্রান্ত কোন প্রমাণও পাওয়া যায়নি। আর বর্ষা শুরুর সাথে সাথে আমাদের অন্যান্য রোগের পরিমাণ বাড়বে।”
‘আউটলুক ইন্ডিয়া’র পক্ষে সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ‘পৃথা নায়ের’।
অনুবাদঃ ডা. মো. রিজওয়ানুল করিম,
ডা. নাওমি নুর