ক্যারি অন পুনর্বহালের দাবীতে দিনভর উত্তাল মেডিকেল শিক্ষাঙ্গণ।
আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে আসছে ক্লাস বর্জনের মত ঘোষণা।
এরপরেও কী দায়িত্বশীলদের পক্ষ থেকে কোন সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত আসবেনা?
সম্মিলিত মেডিকেল শিক্ষার্থীবৃন্দ বাংলাদেশের ব্যানারে আজ (৩/৮/২০১৫) প্রায় কয়েক হাজার মেডিকেল শিক্ষার্থী জমায়েত হয়েছিল ঢাকা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। তাঁদের নির্ধারিত কর্মসুচি ছিলো শহীদ মিনার থেকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় পর্যন্ত পায়ে হেঁটে স্বাস্থ্য মন্ত্রী বরাবর “স্মারকলিপি” দেয়া। সে উদ্দেশ্যে আজ মেডিকেল শিক্ষার্থীরা শতে শতে সমবেত হতে থাকা সকাল থেকে সমবেত হতে থাকে। এক পর্যায়ে তাঁদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির চারপাশ দিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অবস্থান নেয় এবং তাঁদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় উদ্দেশ্যে যাত্রায় বাঁধা প্রদান করে। শৃঙ্খলার স্বার্থে সম্মিলিত মেডিকেল শিক্ষার্থীবৃন্দের পক্ষ থেকে সাত সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল স্বাস্থ্য মন্ত্রীর সাথে দেখা করতে মন্ত্রণালয়ে যেতে রাজি হয়। সেখানে প্রায় ঘন্টা দুয়েক অবস্থানের পর তাঁদের জানানো হয় মন্ত্রী মহোদয় কেবিনেট মিটিং্যের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। প্রতিনিধি দলকে জানানো হয় স্বাস্থ্য মন্ত্রী এ ব্যাপারে অবগত আছেন এবং তিনি সম্ভাব্য ব্যবস্থা নেবেন। অসমর্থিত সূত্র মতে আগামী ৫-৬ আগস্ট এ ব্যাপারে মিটিং হবার কথা আছে। প্রতিনিধিদল স্মারকলিপির কপি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে রেখে আসে। সর্বশেষ খবর, পরবর্তি কার্যক্রম নিয়ে শিক্ষার্থীরা আলোচনা করছে। তাঁদের সাথে যোগাযোগ করে জানা যায়, শিক্ষার্থীরা এমন কোন কিছু করবে না যাতে আলোচনার পথ বন্ধ হয়ে যায়, তাঁরা সকল কে যে কোন ধরণের উত্তেজনা পরিহার করতে অনুরোধ করেছেন।
এদিকে আজ রাজশাহীতে সম্মিলিত মেডিকেল শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে র্যালি শেষে রাজশাহী সিভিল সার্জনের অফিস ঘেরাও করা হয়।শিক্ষার্থীরা এক পর্যায়ে কার্যালয়ের সামনে রাস্তায় বসে পড়ে। সিভিল সার্জন নিচে নেমে আসতে বাধ্য হলে তাঁকে পুর্ব নির্ধারিত স্মারকলিপি প্রদান করা হয়।
এর আগে স্মারকলিপি জমাদানের উদ্দেশ্যে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ থেকে থেকে পদযাত্রা শুরু করে,ইসলামী ব্যাংক মেডিকল কলেজ,রাজশাহী মেডিকেল কলেজ,বারিন্দ মেডিকেল কলেজ,শাহমখদুম মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীবৃন্দ। পরে আগামী কাল থেকে ক্লাস বর্জনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। যতক্ষণ ন্যায্য অধিকার আদায় না হচ্ছে ততক্ষণ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়া হয় সম্মিলিত মেডিকেল শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে। একই ভাবে আব্দুল মালেক উকিল মেডিকেল কলেজ, নোয়াখালীর শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে স্মারক লিপি প্রদান করা হয় নোয়াখালীর সিভিল সার্জন মহোদয়ের কাছে। সিলেট অঞ্চলের মেডিকেল শিক্ষার্থীরাও আজ জড়ো হয়েছিল সিলেট সিভিল সার্জন অফিসের সামনে। এর আগে সম্মিলিত মেডিকেল শিক্ষার্থীবৃন্দের পক্ষে সিলেট অঞ্চলে শাবিপ্রবি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিনের ডিন বরাবর গত ১/৮/২০১৫ তারিখে স্মারক লিপি প্রদান করা হয়। প্রায় দেড় শতাধিক ছাত্র ছাত্রী নিয়ে পাবনা মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে পাবনা জেলার সিভিল সার্জন বরাবর স্মারক লিপি দেয়া এবং সেখানে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় আজ। এ সময় সিভিল সার্জন এর অনুপস্থিতিতে একজন সিনিয়র কন্সাল্টেন্ট বলেন, “ক্যারি অন তুলে নেয়া সম্পূর্ন অযোক্তিক”। আজ যশোর মেডিকেল কলেজের পক্ষ থেকে যশোর বি এম এ এর সভাপতি ও স্বাচিপের সাধারন সম্পাদক ডাঃ কামরুল ইসলাম বেনু স্যার কেও স্মারক লিপি প্রদান করা হয়েছে
দেশব্যাপী সম্মিলিত মেডিকেল শিক্ষার্থীবৃন্দের পক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হয় আজ।
চট্টগ্রামে সকল মেডিকেল কলেজগুলোর শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহনে একটি মিছিল ডিন অফিসে গিয়ে শেষ হয়। ইতিপূর্বে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের পক্ষ থেকে চট্টগ্রামের সকল মেডিকেল কলেজ শিক্ষার্থীদের পক্ষে অধ্যক্ষ বরাবর স্মারকলিপি দেয়া হয়, এবং অধ্যক্ষ অধ্যাপক সেলিম জাহাঙ্গীর তাঁর শিক্ষার্থীদের যথাযথ ব্যবস্থাগ্রহণের আশ্বাস দেন।
প্রায় একই কর্মসূচি পালন করা কম্যুনিটি বেসড মেডিকেল কলেজ এবং ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের পক্ষে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ ক্যাম্পাসে। কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরাও অনুরূপ কর্মসূচি পালন করেন।
গত ১ আগস্ট বাংলাদেশের সকল মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা প্রবল বৃষ্টি উপেক্ষা করে এক যোগে নিজ নিজ শহরে শহীদ মিনার অথবা নিজ ক্যাম্পাসে “ক্যারি অন” বাতিলের অযৌক্তিক সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। এখানে উল্লেখ্য যে, ২০১২ সালে সংশোধিত মেডিকেল কারিকুলাম বিএমডিসির অনুমোদন লাভ করে। নতুন কারিকুলামে পরিবর্তনগুলোর মাঝে একটি ছিল-“ক্যারি অন” নিয়মটি বাতিল করা। ক্যারি অন হচ্ছে কোন একটি পেশাগত পরীক্ষায় কোন বিষয়ে অকৃতকার্য হলে একটি নির্দিষ্ট মেয়াদে নিজ ব্যাচের সাথে পরবর্তি শিক্ষা কার্যক্রমে(লেকচার ক্লাস, টিওটেরিয়াল এবং ওয়ার্ড) অংশগ্রহণ করতে পারার অনুমোদন। ২০১৩-১৪ সালের ভর্তিকৃত শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে নতুন কারিকুলাম অনুযায়ী ক্যারি অনের এই সুযোগটি বাতিল করা হয়। এরফলে একবার পেশাগত পরীক্ষায় খারাপ করলেই শিক্ষার্থীদের নিজ ব্যাচের সাথে পরবর্তি শিক্ষা কার্যক্রমে অংশ গ্রহণ করা(ক্লাস ও ওয়ার্ড) বন্ধ করে দেয়া। এতে শিক্ষার্থীরা যারা একবার পেশাগত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে ব্যর্থ হবেন তাঁদের শিক্ষা জীবন হুমকীর মুখে পড়বে, মানসিক হতাশা এবং অন্যায় জটিলতা সৃষ্টি করবে। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে, শিক্ষার্থীরা প্রথম পেশাগত পরীক্ষায় এক বা একাধিক বিষয়ে অকৃতকার্য হলে পূর্বের ক্যারি অন সিস্টেমের সুযোগে একই সাথে পরবর্তী ক্লাসে লেকচার, ওয়ার্ডের সুযোগ পেলেও অনেক ক্ষেত্রেই তাঁরা ক্লাসে অনুপস্থিত থাকত এবং ওয়ার্ড ও মিস করত বলে শিক্ষকেরা মনে করতেন। এতে মেডিকেল শিক্ষার মান অবনতি হচ্ছিল বলে অনেক শিক্ষক মনে করেন। যদিও খোঁজ নিয়ে জানা গেছে কারিকুলামে ক্যারি অন বাতিল সহ গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনগুলোর ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ শিক্ষকেরা সকলে একমত ছিলেন না। প্রসংগত উল্লেখ করা যায়, দেশে মেডিকেল শিক্ষার মান ক্রমাগত অবনতি হবার অন্যান্য কারণের একটি হচ্ছে বেসিক সাবজেক্টগুলোতে পর্যাপ্ত শিক্ষকের অভাব, কারিকুলাম এবং শিক্ষা উপকরণ উন্নত বিশ্বের মত আধুনিক না, মেডিকেল কলেজগুলোর শিক্ষার সকল সুযোগ সুবিধাও পর্যাপ্ত নয়। ক্যারি অন প্রথা বাতিলের অন্যতম কুফল হিসেবে ভবিষ্যতে মেডিকেল কলেজগুলোতে বেসিক সাবজেক্টে প্রচুর সংখক ডিফল্টার শিক্ষার্থী সৃষ্টি হবে যা শিক্ষক সংকটের ফলে সৃষ্ট সমস্যাকে আরো প্রকট করবে।
ক্যারি অন বাতিলের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে বাংলাদেশের সকল মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের মাঝে অসন্তোষ বেশ কিছুদিন ধরেই বিরাজ করছিল। শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন সময় নিজ নিজ মেডিকেল কলেজের শিক্ষকদের সাথে এ ব্যাপারে যোগাযোগ করলে সুনির্দিষ্ট কোন নির্দেশনা না পাওয়ায় বিভিন্ন সময় নিজ মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন মহোদয়, বিএমডিসির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের সাথে দেখা করেও ইতিবাচক কোন প্রতিক্রিয়া না পেয়ে আন্দোলনের পথে আসতে বাধ্য হয়। সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন টিভি চ্যানলের টকশো তেও অনেক আলোচনার পর সর্বশেষ গত ২/৮/১৫ তারিখে শিক্ষার্থীদের কে এক মাস সময় অপেক্ষা করতে বলা হয়। কিন্তু ততদিনে তাঁদের ক্লাস করতে দেয়া হবে কিনা বা তাঁদের পার্সেন্টেজ কাউন্ট করা হবে কিনা এ ব্যাপারে অফিসিয়ালি কোন কর্তৃপক্ষই দায়িত্ব নিতে চায়নি।
৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৬৯’র গণঅভ্যুথান, ৭১’র মহান মুক্তিযুদ্ধ, ৯০’র স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে মেডিকেল শিক্ষার্থী এবং চিকিৎস্ক এবং মেডিকেল শিক্ষার্থীদের ভূমিকা জনসাধারণে অজানা নয়। তবে শিক্ষার্থদের নিজেদের অস্তিত্বের জন্য এভাবে স্বতস্ফূর্তভাবে পথে নামার মত পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়া দুঃখজনক। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সকলের আন্তরিকভাবে ভূমিকা রাখার অনুরোধ জানাচ্ছি। আজ শহীদ মিনারে “ক্যারি অন” পুনর্বহালের পক্ষে পঠিত কবিতা থেকে কোট করছি-“স্বপ্ন নিয়ে ছিনিমিনি,
খেলতে দিবো না আর
নো টলারেন্স ক্যারি অনে,
দিব না কোন ছাড়”। অথবা “আমি সেইদিন ফিরবো ঘরে
যেদিন রাজপথে আর নামতে হবে না,
ক্যারি অন এর তরে..”।
মেডিকেল শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলনে এ স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণ নজিরবিহীন। সম্মিলিত মেডিকেল শিক্ষার্থীবৃন্দের এ “সাদা বিপ্লব” এর সাফল্য কামনা করছি “প্ল্যাটফর্ম” বাংলাদেশের চিকিৎসক এবং মেডিকেল শিক্ষার্থীদের প্রথম মিডিয়ার পক্ষ থেকে।
CARRY ON MUST ON
ডাঃ মোহিব নীরব