প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ১০ আগস্ট, ২০২০, সোমবার
রাত দুটো। মেয়ের বয়স ষোল বছর। ফাল্গুনী পাঠকের মতো চুলের কাট। এমনভাবে হাত ঝাঁকাচ্ছিল যেন হাত খুলে পড়ে যাবে। তার হাত ঝাঁকানোর কারণ তার বাবা ঔষধ নিয়ে আসছে না। এতো রাতে সব ফার্মেসি বন্ধ। বন্ধ মানে শাটার নামিয়ে ভেতরে লোক ঘুমাচ্ছে। জোরে ডাকলে সাড়া দেয়। তিনি তার মেয়ের জন্য স্কয়ারের ওমিপ্রাজল খুঁজছেন। স্কয়ারের ওমিপ্রাজল কেউ দিতে পারছে না।
ফাল্গুনী পাঠক প্রমাণ করতে চাচ্ছে সে ব্যথায় মরে যাচ্ছে। পাশে দাঁড়ানো মা ও অস্থির। বারবার ফোন দিচ্ছে। তার পরের রোগী বুকে ব্যথা নিয়ে এসেছেন। সাথে বুকভার, হাতে শিরশিরানি। বললাম ইসিজি (ইলেক্ট্রোকার্ডিওগ্রাম) লাগবে। পাশে বসা স্যাকমো সাহেব বললেন,
“এতো রাতে শুধু অমুক ক্লিনিকেই ইসিজি করা যাবে।”
ইসিজি আমাদের হাসপাতালেও হয়। উনারা করেন না। সম্ভবত পার্সেন্টেজের ব্যাপার আছে। ত্রিশ টাকার ইসিজি তিনশো টাকা রাখা হবে। সেখান থেকে একটি অংশ রেফারেল বাবদ উনি পাবেন। আমার বিশ্বাস কে কি পাঠাচ্ছে সেগুলোও সুন্দর করে লিখে রাখা হয়। ঈমান সহকারে দুর্নীতি খুব বেশি জাতি করে না। আমরা করি। আমি পারতাম ইসিজি করতে। কিন্তু মানুষের উপকার করা ছেড়ে দিয়েছি প্রায় দশ বছর হয়!
তারপরে আরেকজন আসলো বাইশ বছরের মেয়ে। প্রচণ্ড কোঁকাতে কোঁকাতে। স্যাকমো সাহেব জিজ্ঞেস করলেন,
“লেবার পেইন কতক্ষণ? দোতালায় সিস্টার আছে সিস্টারের কাছে যান।”
আমাদের প্রেগনেন্সি রিলেটেড সিদ্ধান্ত সিস্টাররা নেয়। কোন রোগী এখানে থাকবে, কোন রোগী রেফার হবে সব সিস্টারদের মর্জি। ডাক্তারের কাজ শুধু অর্ডার দেওয়া। রোগীর লোক বললো,
“গর্ভবতী না, এমনিই পেটে ব্যথা।”
এ স্যাকমো ভদ্রলোক একটু বেশি কথা বলেন। প্রত্যেক ঔষধ লেখার আগে আমাকে জিজ্ঞেস করেন। মধুর ভাবে বলেন,
“স্যার দিব?”
আমি কখনো হুঁ বলি, কখনো চুপ থাকি। অঅধীনস্থদের সবসময় কনফিউশানে রাখতে হয়- এটি সরকারি চাকরির প্রথম নিয়ম। কিছু না বলে ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকা এর জন্য।
ফাল্গুনী পাঠক দেখলো নতুন রোগী বেশি এটেনশন পাচ্ছে সে চিৎকার বাড়িয়ে দিলো। দ্বিতীয় রোগীর হার্ট এট্যাক, বুঝতে পারছে না ইসিজি করে খরচ আরো বাড়াবে কিনা। তৃতীয় রোগী তার পজিশন ধরে রাখতে মরিয়া। স্যাকমো সাহেব এক গাদা ইঞ্জেকশন-ঔষধ লিখে দিয়েছেন সবাইকে। খুব খেয়াল করে লিখেছেন যারা নিয়মিত ভিজিট করে শুধু তাদের মধ্যে সব রাখতে। ঈমান সহকারে দুর্নীতি খুব বেশি জাতি করে না!
প্রতিদিন একই নাটক। একই স্ক্রিপ্ট। শুধু অভিনেতা-অভিনেত্রীরা ভিন্ন। এ ছোট মেয়েটা আরো কিছুক্ষণ তার বাপ মাকে নিয়ে খেলবে। তারপর বলবে,
“পুরোপুরি কমে নি, এখনও আছে।“
এরপর আমাদের দিকে ক্ষমার দৃষ্টিতে চেয়ে বিদায় নিবে। দ্বিতীয় বুড়ো রোগীটার পেইন আরেকটু বাড়বে। পরে ভয়ে যাবে ইসিজি করাতে। আমরা ইসিজি দেখে রেফার করে দিবো। এখানে ব্যবস্থা নেই। যে রোগগুলোর ইমার্জেন্সি চিকিৎসা দরকার সেগুলোরই ব্যবস্থা নেই। মূলত রোগীর সময় নষ্ট করা ছাড়া আমরা তেমন কিছু করি না। আমরা পাঠাই সদর হাসপাতালে। সেখানেও প্রায় একই অবস্থা। তবু্ও সেখানে পাঠাই কারণ ঢাকার কথা বললে যাবে না। নিজের ঘাড় হালকা রাখা ফাইনেস্ট স্ট্র্যাটেজি। তৃতীয় জনের ব্যথা কমবে না। ভর্তি হবে। কাল সরকারি পয়সায় সব টেস্ট করাবে, রিপোর্ট সব নরমাল আসবে। তারপর হঠাৎ কোন এক সময় চলে যাবে। এসব রোগীর আসা যাওয়া সব মর্জি মাফিক। ব্যাথার ইঞ্জেকশন পেয়েছে। ফাল্গুনী পাঠক এবার সত্যি সত্যি চিৎকার করলো। পেয়েই বললো,
“ব্যথা এখন আগের জায়গায় নেই। নিচে নামছে।”
আমি বললাম,
“হাঁটুতে নামুক। হাঁটুতে নামলে ছেড়ে দিব।”
কপট ভানে বললো,
“এরপর হাঁটুতে ব্যথা নামবে?”
নামেই তো। নামতে নামতে মাটিতে চলে যায়। এজন্য মাটি সর্বংসহা। এতোকিছু দেখেও কেঁপে কেঁপে উঠে না।
রিলেশনশিপে প্রোটেক্টিভ ও পসেসিভ- এ দুইয়ের মাঝে পার্থক্য করতে পারে না অনেকেই। প্রোটেকশন দিতে গিয়ে পুরো বন্দী করে ফেলেন। এটি কোভিডের সময়। যখন মানুষ ‘রিফ্রেশ’ বাটন প্রেস করছে খুব দ্রুত। এরকম সমস্যা তৈরি হচ্ছে বেশি। এ দেশে কোনো স্টাডি নেই। তবে এখন দেখছি প্রয়োজনহীন হাসপাতালে আসার হার অনেক বেড়েছে। অসুস্থ সেজে পরীক্ষা করে সে কতটা গুরুত্বপূর্ণ। তার জন্য তার কাছের লোকেরা কতদূর যেতে পারে। বড় ভয়ংকর এ পরীক্ষা। কিন্তু আজকাল অনেক বেশি হচ্ছে।