সুখী দম্পতির সুখের সংসারে অনাগত ছেলে সন্তানের খবরে সবাই খুব খুশি। সিজারের মাধ্যমে বাচ্চা ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর নাড়ী কাটা হলো কিন্তু নাভি থেকে রক্তপড়া যেন বন্ধই হতে চায় না! বাচ্চা যখন হাত-পা ছুড়তে থাকে, হামাগুড়ি দিতে শিখে তখন আপনা-আপনি হাঁটু, কনুই, পায়ের গোড়ালি ফুলে যায় ও মাংসপেশীতে কালো কালো দাগ দেখা যায়। বাচ্চা প্রচন্ড কান্নাকাটি করে, হাত-পা ছুড়াছুড়ি করা ও খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দেয়।
খেলাধুলার সময় সামান্য আঘাতে মাংসপেশীতে কালো কালো দাগ পড়ে, গীড়া (joints) ফূলে যায়। দাঁত পড়লে রক্তপড়া বন্ধ হতে চায় না। সুন্নতে খৎনা করার সময় প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়।
প্রতিটি লক্ষণ শুরু হলেই হাসপাতালে যেতে হয়। অত্যন্ত দামী ইঞ্জেকশন (Factor) অথবা সাদা রক্ত ( FFP/cryoprecipitates) দিতে হয়। সুখের সংসারে আসে অভাব। শেষমেশ একমাত্র সন্তানকে সময় মতো সঠিক চিকিৎসা দিতে না পারায় রক্তক্ষরণ হতে হতে এক সময় সন্তান হারা হয়।
গল্পটা সুখী দম্পতির।
ছেলেটা হিমোফিলিয়ার রুগী ছিল। কী ভয়াবহ পরিণতি হতে পারে তা হিমোফিলিয়া রুগীর পরিবারই উপলব্ধি করতে পারে। আমরা চিকিৎসক তার সাক্ষী মাত্র।
হিমোফিলিয়া কি বা কেন হয়?
হিমোফিলিয়া একটি রক্তক্ষরণজনিত জন্মগত রোগ যা বংশানুক্রমে ছেলেদের হয়ে থাকে (X-link recessive disorders).
স্বাভাবিকভাবে, শরীরের কোন জায়গায় আঘাত পেলে বা সামান্য কেটে গেলে ঐ স্থান থেকে রক্তক্ষরণ হতে থাকে এবং আপনা-আপনি বন্ধ হয়ে যায়। হিমোফিলিয়া রুগীর ক্ষেত্রে সহজে রক্তক্ষরণ বন্ধ হয় না অথবা বিলম্বিত হয়। সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা না নিলে জীবনের মারাত্মক ঝুঁকি থাকে।
মানব দেহে যদি একটি X ও অন্যটি Y ক্রোমোজম থাকে তবে সে হয় ছেলে (46,XY) আর যদি দুইটিই X ক্রোমোজম থাকে তবে সে হয় মেয়ে (46,XX).
X ক্রোমোজমে F8 ও F9 নামক জীন থাকে যা F-VIII ও F-IX নামক ক্লোটিং প্রোটিন তৈরি করে। এই ক্লোটিং প্রোটিন রক্তের সাদা অংশে পরিমাণ মতো থাকে। ফলে কেটে গেলে রক্ত জমাট বেঁধে আপনা-আপনি রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়। যাদের রক্তে এই ক্লোটিং প্রোটিন (F-VIII / F-IX) কম থাকে তাদের রক্তপড়া বন্ধ হয় না অথবা বিলম্বিত হয়। এরাই হিমোফিলিয়ার রুগী।
ছেলেদের (46,XY) দেহে যেহেতু একটা মাত্র X ক্রোমোজম থাকে এবং এই একমাত্র X ক্রোমোজম যদি অসুস্থ/defect থাকে তাহলে F-VIII/F-IX তৈরি হয় না ফলে ছেলেরাই হিমোফিলিয়ার রুগী হয়।
আর মেয়েদের (46,XX) দেহে যেহেতু দুইটিই X ক্রোমোজম থাকে তাই একটি X অসুস্থ/defect হলেও অন্য X সুস্থ থাকে ফলে F-VIII/F-IX তৈরি হয়।
তাই মেয়েরা হিমোফিলিয়ার রুগী হয় না, রোগের বাহক হয়। তবে
১). Lyonisation / inactivation of healthy X chromosome হলে
২). বাবা রুগী ও মা বাহক হলে অথবা
৩) Turner syndrome (45,XO) হলে মেয়েরাও রুগী হতে পারে। তাই হিমোফিলিয়ার রুগীর সাথে তো তো বোনের (মামাতো, খালাতো) বিয়ে হলে ছেলে ও মেয়ে উভয়েরই রুগী হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
তবে পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, প্রতি ৩ জন হিমোফিলিয়ার রুগীর মধ্যে অন্তত ১ জন রুগী বংশানুক্রমে সঞ্চারিত না হয়ে নতুনভাবে আক্রান্ত হয়।
বংশানুক্রমে সঞ্চারিত কিভাবে হয়?
১). যদি বাবা সুস্থ এবং মা বাহক হয় তবে ছেলে সন্তানের রুগী হওয়ার সম্ভবনা ৫০% আর মেয়ে সন্তানের বাহক হওয়ার সম্ভবনা ৫০%.
২). যদি বাবা রুগী এবং মা সুস্থ হয় তবে সমস্ত ছেলে সন্তানই সুস্থ হবে এবং সমস্ত মেয়ে সন্তানই বাহক হবে। সুতরাং প্রত্যেক হিমোফিলিয়া পুরুষ রুগী বিয়ে করতে পারবে, তবে সন্তান নেওয়ার সময় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের/রক্তরোগ বিশেষজ্ঞের উপদেশ নিতে হবে।
৩). যদি বাবা রুগী এবং মা বাহক হয় তবে ছেলে সন্তানের রুগী হওয়ার সম্ভবনা ৫০%. আর মেয়ে সন্তানের রুগী হওয়ার সম্ভবনা ২৫%, বাহক হওয়ার সম্ভবনা ২৫%.
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকগণ ভূক্তভোগী পরিবারের সদস্যদের genetic testing, genetic counseling and prenatal test (amniocentesis) করে অনাগত সন্তান রুগী না বাহক তা নিশ্চিত হয়ে হিমোফিলিয়ার আক্রান্তের সংখ্যা কমাতে পারে। আমাদের দেশেই এসব পরীক্ষা করা হচ্ছে।
হিমোফিলিয়া রোগকে একেবারে সারানোর কোন চিকিৎসা এখনও আবিষ্কার হয় নাই। তবে জীন থেরাপি গবেষণায় রয়েছে।
সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে যেমন: নিয়ম মাফিক বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত F-VIII / F-IX শিরায় ইঞ্জেকশন নিয়ে, রক্তের সাদা অংশ (FFP, Cryoprecipitates) নিয়ে, সঠিক ব্যায়াম করে মোটামুটিভাবে স্বাভাবিক জীবন যাপন করা গেলেও চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল হওয়ায় অনেকের পক্ষেই তা সম্ভব হয় না। তাই সচেতনতার মাধ্যমে প্রতিরোধ করাই উত্তম।
নিষেধ :
১). আঘাত পাওয়ার সম্ভাবনা আছে এমন খেলাধুলা নিষেধ।
২). মাংসে ইঞ্জেকশন দেয়া নিষেধ।
৩). বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের/রক্ত রোগ বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধান ছাড়া ছোট থেকে বড় সমস্ত অপারেশন
নিষেধ।
৪). Anticoagulants (Heparin, Warfarin), NSAIDs (Aspirin, Naproxen etc) নিষেধ।
লিখেছেন:
ডা. মোহাম্মদ কামরুজ্জামান
সহকারী অধ্যাপক
ডিপার্টমেন্ট অব হেমাটোলজী
ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ