প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২০, শুক্রবার
অধ্যাপক ডা. ফাতেমা আশরাফ
বিভাগীয় প্রধান (অবস্ ও গাইনী)
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল।
গর্ভবতী মা কোভিড কালীন সময়ে নিজে কি করবেন?
১. নিজ গৃহে অবস্থান করবেন। জরুরী প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে আসবেন না।
২. নিজের খাওয়া দাওয়া ও বিশ্রামের দিকে যত্ন নিবেন। এই লেখনীতে বিভিন্ন সময়ে সাধারণ ভাবে চলার পরামর্শগুলি পালন করবেন।
৩. সব সময় মন ভালো রাখার চেষ্টা করবেন।
৪. যে সময়ে যে ওষুধ সেবন প্রয়োজন, তা গ্রহণ করবেন।
৫. রাষ্ট্র বা প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি পর্যায় থেকে যে টেলিমেডিসিন এর সেবা দেওয়া হয়, তা গ্রহণ করতে হবে। সেক্ষেত্রে বেছে নিতে হবে, যে যে বিষয়ের দক্ষ সে ঠিক সেই বিষয়টি নিয়ে বলছেন কি না। মনে রাখতে হবে এই রকম মহামারীর সময় নানা ধরণের তথ্য দূষণ ঘটতে পারে।
৬. জটিল সমস্যা বা বিপদের মাত্রা বুঝতে শিখবেন এবং জটিল পরিস্থিতির উদ্ভব হলে সংগে সংগে হাসপাতালে যাবার জন্য প্রস্তুতি নিবেন।
৭. ঘরে থেকেও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখবেন।
৮. কিছুক্ষণ সময় পর পর ২০ সেকেন্ড সময় ধরে হাত ধুবেন।
৯. মুখে, নাকে বা চোখে স্পর্শ করবেন না।
১০. বাড়ীতে জ্বর কাশির রোগী থাকলে তাকে মাস্ক পরতে বলবেন। অন্ততঃ ৬ ফুট দূরত্বে থাকবেন এবং নিজেও মাস্ক ব্যবহার করবেন।
১১. কিভাবে প্রসব হওয়াতে চান তা পরিকল্পনা করবেন। বাচ্চা ডেলিভারীর সাথে সাথে বুকের দুধ খাওয়ানো ও জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণের পরিকল্পনা করবেন।
Close partner বা স্বামী কি করবেন?
১. গর্ভকালীন বিভিন্ন পর্যায়ে কোনগুলি স্বাভাবিক লক্ষণ ও কোনগুলি জটিলতার লক্ষণ তা জানাবেন। বিপদে কোথায় কিভাবে যাবেন সেটা পরিকল্পনায় রাখবেন।
২. মায়ের খাবার ও বিশ্রামের দিকে নজর দিবেন।
৩. মাকে ভালোবাসবেন, সহমর্মিতা প্রকাশ করবেন এবং মায়ের মন চাঙ্গা রাখবেন।
৪. জটিল অবস্থার সৃষ্টি হলে একটুও অপেক্ষা না করে তাকে নিকটস্ত হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করবেন।
পরিবারের করণীয়-
১. গর্ভবতী মা যেন কোভিড আক্রান্ত না হন, সেদিকে নজর রাখবেন।
২. মায়ের শরীর ও মনের যত্নের ব্যবস্থা নিবেন।
৩. মায়ের চিকিৎসার জন্য অগ্রিম পরিকল্পনা করবেন ও প্রয়োজনের সময় প্রয়োজনীয় কাজগুলি করবেন।
৪. জটিল অবস্থার সৃষ্টি হলে একটুও অপেক্ষা না করে তাকে হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করবেন।
রাষ্ট্রের ও চিকিৎসালয়ের করণীয়-
১. গর্ভবতী মা যে কোন অবস্থায় যে কোন হাসপাতালে গেলে তার তাৎক্ষণিক পরিচর্যা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকতে হবে। মাকে যথাযোগ্য মর্যাদায় সেবা দিতে হবে।
২. মায়ের জীবন ঝুঁকিপূর্ণ না হয়, সে জন্য চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা কে সক্ষমতা অর্জন করতে হবে।
৩. প্রসূতি বিভাগের ব্যবস্থাপনায় এইচডিইউ এবং আইসিইউ থাকতে হবে।
৪. প্রসূতি বিষয়ে critical service সেবার জন্য হাসপাতালের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলির সমন্বয়ে একটি obstretical critical care team থাকতে হবে। উক্ত টিম ৭/২৪ ঘণ্টা active থাকবে।
৫. রোগীর রেফারাল সঠিক ব্যবস্থাপনার মধ্যে থাকতে হবে, যেন পথে রেফারকৃত রোগীর অবস্থার অবনতি না ঘটে।
৬. হাসপাতালের সকল কর্মকর্তা অ কর্মচারীদের প্রসূতি সেবার বিষয়ে সঠিক প্রশিক্ষণ দিতে হবে।যন্ত্রপাতি ও ঔষধ পত্রের সরবরাহ সুনিশ্চিত করতে হবে।
৭. সেবাদান কেন্দ্রের পরিবেশগত উন্নয়ন করতে হবে যাতে কি না মায়ের মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক থাকে।
৮. মায়েদের চিকিৎসা সেবা দানকারী স্বাস্থ্যকর্মীদের সঠিক যত্ন নিতে হবে এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানোর মানসিকতা থাকতে হবে ও পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।
৯. সুস্থ থাকলেও মাতৃত্ব কালীন সেবার জন্য মাকে কিছু সময় সেবা দানকারীর নিকট সরাসরি গিয়ে সেবা নিতে হবে। সরাসরি সেবা নেবার বিষয়টি ৪ থেকে ৬ বার এর মধ্যে সীমিত রাখতে হবে। যথাঃ
১৬ থেকে ১৮ সপ্তাহের মধ্যে ১ম বার
২৪ থেকে ২৬ সপ্তাহের মধ্যে ২য় বার
২৮ থেকে ৩২ সপ্তাহের মধ্যে ৩য় বার
৩৬ সপ্তাহ বা এর পরে ডেলিভারীর পূর্ব পর্যন্ত ৪র্থ বার
বাকী দুই বার শরীরের প্রয়োজন অনুসারে।
কোভিড-১৯ কালীন সময়ে মায়ের জটিল সমস্যা দেখা দিলে মা কে কোথায় কিভাবে নিয়ে যাবেন?
১. বর্তমানে সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী সকল চিকিৎসালয়ে কোভিড পজিটিভ, কোভিড নেগেটিভ এবং সন্দেহ জনক কোভিড গর্ভবতী রোগীদের যথাযথ চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। সেই অর্থে আপনার নিকটবর্তী যে কোন সরকারী বা বেসরকারী হাসপাতালে যেখানে আপনার চিকিৎসার সু-ব্যবস্থা আছে সেখানে যাবেন।
২. মাকে কিভাবে হাসপাতালে নিয়ে যাবেন সেটা আগেই পরিকল্পনায় রাখুন। যাতে রাত-বিরাতে সহজেই মাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে কোন সমস্যায় পড়তে না হয়।মনে রাখতে হবে এই সময়ে যতটা গণপরিবহন এড়িয়ে চলতে হবে।
৩. মায়ের সাথে কে কে চিকিৎসালয়ে যাবেন তা আগে থেকেই ঠিক করে রাখতে হবে। মনে রাখবেন এই সময়ে হাসপাতালের ভীড় যতটা সম্ভব কমিয়ে রাখতে হবে। সেই জন্য মায়ের সহযোগী একজন মাত্র সুস্থ মহিলা মায়ের সঙ্গে থাকবেন এবং একজন পুরুষ ছেলে যদি থাকার প্রয়োজন হয়, তিনি যেন সার্বক্ষণিক মহিলা ওয়ার্ডের বাহিরে থাকেন।
একজন গর্ভবর্তী মা কোভিড থেকে কিভাবে নিজেকে সুরক্ষা করবেন?
১. নিজ গৃহে অবস্থান করবেন। অত্যাবশকীয় প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে আসবেন না। একান্ত জরুরী হলে বাইরে আসার সময় মুখে মাস্ক ব্যবহার করবেন ও সামাজিক দূরত্ব মেনে চলবেন।
২. গৃহে অন্যান্য সদস্যদের সাথে সামাজিক দূরত্ব বজিয়ে চলবেন।
৩. বাড়িতে কোন হাঁচি কাশির রোগী থাকলে তাকে দুরে রাখুন ও মাস্ক পরিধান করুন।
৪. কিছু সময় পর পর ২০ সেকেন্ড সময় ব্যাপী সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলুন।
৫. মুখে, নাকে ও চোখে অযাচিত ভাবে হাত স্পর্শ করবেন না।
৬. পুষ্টিকর খাবার খাবেন, বিশ্রাম নিবেন ও মন চাংগা রাখবেন।
কোভিড আক্রান্ত হলে গর্ভবতী মায়ের করণীয়-
১. অন্যকে যেন রোগটি না ছড়ায় সেটি নিশ্চিত করাঃ মায়ের যদি কোভিড এর সম্ভাব্য লক্ষ্মণগুলি থাকে (জ্বর, কাশি, মাথা ব্যথা, গলা ব্যথা ইত্যাদি) অথবা মা যদি কোভিড পজিটিভ হন তবে-
i. তাকে ঘরে থাকতে হবে। শতকরা ৮০ ভাগ মানুষই অল্প সমস্যায় ভুগে থাকেন এবং সেক্ষেত্রে নিজ বাড়িতে অবস্থানই শ্রেয়। গৃহে অন্যান্য সদস্যদের সাথে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলুন।
ii. বাড়ির মধ্যে নিজের ব্যবহারের সম্পূর্ণ ভিন্ন ঘর এবং বাথরুম সুবিধা থাকলে ভাল।
iii. চিকিৎসার জরুরী ছাড়া তিনি ঘরের বাইরে বের হবেন না। সেক্ষেত্রে গণ পরিবহণ এড়িয়ে চলবেন।
২. নিজের শরীরের যত্ন নিবেন-
i. সেক্ষেত্রে আমিষ জাতীয় খাবার (মাছ, মাংস, ডিম, ডাল, দুধ ইত্যাদি), ভিটামিন ‘সি’ যুক্ত খাবার (লেবু, কাচামরিচ, আমলকি, আমড়া, মাল্টা, বাতাবী লেবু ইত্যাদি) বেশী বেশী করে খাবেন।
ii. শরীরে পানির সরবরাহ ঠিক রাখতে পানি বা পানিজাতীয় খাবার বেশি খাবেন।
iii. প্রতিদিন শরীরে রোদ লাগাবেন।
iv. নিজ ঘরে থেকে স্বাভাবিক চলাফেরা করতে পারবেন।
v. ভয় পাবেন না এবং পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিবেন।
৩. চিকিৎসা সহায়তা- যে কোন সাধারণ বিষয়ক প্রয়োজনে টেলিমেডিসিন সেবা গ্রহণ করুন। প্রয়োজনের মাত্রা অনুসারে সরাসরি আপনার চিকিৎসকের সংগে কথা বলুন অথবা নিকটস্থ সেবাদান কেন্দ্রে আসুন।
৪. নিজের সমস্যা বা লক্ষ্মণগুলির প্রতি গভীর মনোযোগ রাখুন- যদি শ্বাসকষ্ট, বুকে চাপ বা ডায়রিয়া হয়, খুব দূর্বল লাগে, অথবা অক্সিজেন স্যাচুরেশন< ৯৩% হয় তাহলে সংগে সংগে চিকিৎসকের সংগে ফোনে যোগাযোগ করবেন ও কোভিড হাসপাতালে ভর্তি হবেন।
৫. চিকিৎসার প্রয়োজনে ঘরের বাইরে আসার প্রয়োজন হলে ফেস মাস্ক ব্যবহার করবেন ও গণ পরিবহণ এড়িয়ে চলবেন।
গর্ভবতী মায়েদের করণীয় সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে নিচের বইটি ডাউনলোড করে নিনঃ
https://drive.google.com/file/d/1W9iMB3HlsdUvO_2POWIib6WlGtY_jVua/view?usp=drivesdk
নিজস্ব প্রতিবেদক/ সারোয়ার জাহান সাকিব