লিখেছেন: ডা. ফারজানা রিমি, lowa city, usa
ডাক্তারি পাশ করে যখন ইন্টার্নশিপ করতে ঢুকলাম, তখন দেখলাম, মেডিসিন ওয়ার্ড এর সবচেয়ে অবাঞ্ছিত রোগের নাম- Conversion Disorder. কেউ কেউ বলে- FD (Functional Disorder)..
কী হয় এই রোগে? – রোগী এমন কিছু বিচিত্র শারীরিক সমস্যা নিয়ে হাজির হয়, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে যার কোন কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। এটা একটা Psycho-Somatic Disorder। কোন প্রবল মানসিক চাপ, হীনমন্যতা বোধ, কাছের মানুষদের অবহেলা – যে গুলো রোগী কারো কাছে প্রকাশ-ও করতে পারছে না; এ সব কিছু থেকেই, হঠাত করে রোগীর মধ্যে এমন কিছু শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে, যার কোন ব্যাখ্যা নেই।
১। দেখা গেলো, এক ২২ বছর বয়সী গৃহবধূ , হুট করেই, হাঁটা-হাঁটি করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে! হাঁটতে না পেরে, সে কান্না-কাটি করছে। যে স্বামী বেচারা, বউ এর অবহেলিত জীবন, আর হাড়-ভাঙা খাটুনির খুব একটা খবর রাখতে পারে না, সে-ও কাঁদো-কাঁদো মুখে, বউকে কোলে করে, হসপিটালে নিয়ে এসেছে। বুঝলাম- মহিলার আর কিছুই না! Conversion Disorder! আমাদেরই একজন ডাক্তার, রোগীর হাজব্যান্ডকে, এই তথ্যটি জানালো হলও – “ওনার আসলে কোন শারীরিক সমস্যা নেই। মনের উপর কোন চাপ থেকে এটা হয়েছে।” … রোগী এবং রোগীর স্বামী- দু’জনই বলতে গেলে, হতাশ!- “তার মানে কোন ‘অসুখ’ নাই! শুধু শধু!!” ..২ দিন পর রিলিজ নিয়ে, গোমড়া মুখে তাঁরা হসপিটাল ত্যাগ করলো।
ও দিকে, চির-অবহেলিত, ২২ বছর বয়সী গৃহবধূর জন্য এক প্রকারের সুখের স্মৃতি হয়ে রইলো এ সব – …সংসারের একঘেয়ে কাজ থেকে ২ দিনের আকস্মিক অবকাশ… স্বামীর কোলে চড়ে হসপিটালে আসা… হঠাত করে তাঁকে ঘিরে আত্মীয়-স্বজনের উদ্বিগ্নতা… … বহুকাল সে এতো মনোযোগ পায় নি! …
২। ১৮ বছর বয়সী এক কলেজ পড়ুয়া ছেলে- তাঁর বুকের বাম পাশে হঠাত করেই ভীষণ ব্যথা। ব্যস্ত বাবা-মা, কাজ ফেলে আজ ছেলেকে নিয়ে এসেছেন। তাঁদের মুখ কালো মেঘে ঢাকা! ২-৩ জন বন্ধুকেও পাওয়া গেলো আশে-পাশে..
-“আমি এখানকার ডাক্তার। কোথায় ব্যথা তোমার, বল তো?”
-“আ আ আহ! উ উ উহ! এই যে এখানে এ এ !!!”
…ঠিক তাঁর Heart টাকেই দেখিয়ে দিলো সে! সে জানে, তাঁর হার্ট টা ওখানে। কিন্তু জানে না, হার্টের ব্যথা টা কেবল হার্টের ওপরেই হয় না!
২ দিন তাঁকে যেন আমরা কিছুটা দয়া করেই হাসপাতালে স্থান দিলাম। তারপর, ১৫ দিনের জন্য হালকা ‘উদ্বিগ্নতা-নাশক’ ওষুধ দিয়ে, বিদায় করে দিলাম। …ভাবলাম না, – ছেলেটার HEART এ না হয় কোন অসুখ নেই; কিন্তু তাঁর ‘হৃদয়’ এ যে অসহায় ব্যথা- তার কী হবে!!
৩। আরেক গৃহবধূ ১৯ বছর বয়স তাঁর। তাঁর না কি ক্রমাগত হেঁচকি উঠছে। কিছুতেই থামছে না! হেঁচকি দেখে, আমরা পাতি ডাক্তাররা হতভম্ব। আমাদের দুশ্চিন্তা দেখতে দেখতে, রোগীও একটু হতভম্ব (কারণ, আমাদের দেখে তাঁর হেঁচকি একটু কমেছে!)।
সিনিয়র ডাক্তার এলেন-
-“কী, মা! হেঁচকি কি একটু কম মনে হচ্ছে??”
রোগী মাথা নাড়ল।
-“আহ হা! আমি তো দেখতে পারলাম না! ট্রিটমেন্ট দেব কেমন করে! তা কী রকম করে হেঁচকি ওঠে, একটু দেখাতে পারবেন আমাকে??”
– রোগী বিনা বাক্য ব্যয় এ, হেঁচকি তুলতে শুরু করলো…
আমরা তো আমরা! রোগীর আত্মীয়-স্বজনও নিঃসন্দেহ হয়ে গেলো- এর আসলে কোন ‘অসুখ’ নেই!
সকাল সন্ধ্যা round দিতে গিয়ে, আমরা মুখ চিপে হাসতে হাসতে, এই রোগীর সাথে আলাপ করতাম। …এনাকেও ২ দিনের বেশি রাখার কোন কারণ নেই। নতুন নতুন, গুরুত্বপূর্ণ পেশেন্ট আসছে আমাদের। তাঁদের সিট দরকার।
আমাদের হাসির পাত্রটি, তাঁর চরম বিরক্ত আত্মীয়-স্বজনের হাত ধরে, তাঁর চিরকালীন জীবনযাত্রায় ফিরে গেলো…
… কিন্তু আবার সে ফিরে এল এক সপ্তাহের ভেতর। সেই এক-ই সমস্যা! আমরা তো পারলে তাঁকে ভর্তি-ই নেই না! পরের দিন-ই তাঁকে Release করার অর্ডার দেওয়া হল…!
___ হ্যাঁ! আমার মন কাঁদল। বুকের ভিতর মুচড়ে উঠলো ব্যথায়।
____ আহা রে বোন আমার! আহা রে!! আমরা কতো অসহায়! শরীরের ব্যথা নিয়ে যে আসে, তাঁকে কতো চিকিতসা দেই আমরা। সে সুস্থ হয়ে, বাড়ি ফিরে যায়। …তুই যে আসিস মনের গহীনে ব্যথা নিয়ে রে পাগলী! তুই কীভাবে সুস্থ হবি?? সবাইকে বিরক্ত করেই, তুই বারবার ফিরে আসবি! আমরাও বিরক্ত হব, ঠিক না?! … কারণ, আমরা ব্যর্থ!!
_____ তবে শুনে রাখ – আমরা বসে নেই…! তোদের পাশে দাঁড়াবোই, ইন শাআ আল্লাহ্! পৃথিবীর মনঃরোগবিদ্যা, এখনো বড়ই শিশু। একে দাঁড়া করাতে হবে। …আমরা থাকবো তোদের পাশে! …দেখিস!