দ্রুত কলেরা রোগ নির্ণয় পদ্ধতির উদ্ভাবন করেছেন ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ডায়ারিয়াল ডিজিজ রিসার্চ, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর,বি) বিজ্ঞানীরা। রোগ নির্ণয় পদ্ধতির অংশ হিসেবে বিজ্ঞানীরা স্থানীয়ভাবে কলকিট নামের একটি ডিপস্টিক তৈরি করেছে।
কলকিট আরডিটি (রোগ নির্ণয় পরীক্ষা) মলে ভিব্রিও কলেরি চিহ্নিত করতে সক্ষম। এটি এমন একটি ইমিউনোক্রোমাটোগ্রাফিক ডিপস্টিক পরীক্ষা পদ্ধতি, যা মলের নমুনাযুক্ত টিউবের মধ্যে ডোবালে সর্বোচ্চ ১৫ মিনিটের মধ্যে যথাযথ ফলাফল (খালি চোখে দৃশ্যমান রঙ্গীন ব্যান্ড) প্রদর্শন করে।
বাংলাদেশ এবং বহির্বিশ্বে কলেরা রোগ সংক্রমণের শুরুতে দ্রুত এবং কার্যকরভাবে তা শনাক্ত করার লক্ষ্যে যৌথ উদ্যোগে এ ডিপস্টিক তৈরি করেছে আইসিডিডিআরবির বিজ্ঞানীরা ও ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস। কলকিট তৈরির কাজে নেতৃত্ব দিয়েছেন আইসিডিডিআরবির সংক্রামক রোগ বিভাগের বিজ্ঞানী ড. ফেরদৌসী কাদরী।
ফেরদৌসী কাদরী বলেন, ‘ঐতিহাসিকভাবে দেখা যায় যে, এই অঞ্চল থেকেই বিশ্বের সাতটি মহামারীর সবগুলোর বিস্তার ঘটেছে। কলেরা রোগের দ্রুত শনাক্তকরণের ওপর এ রোগের ব্যবস্থাপনা নির্ভর করে। বর্তমানে কলেরা শনাক্তকরণের উদ্দেশ্যে গবেষণাগারে মলের কালচার পরীক্ষার পাশাপাশি আমদানি করা দ্রুত রোগ নির্ণয় কিট ব্যবহৃত হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এখন বাংলাদেশে স্থানীয়ভাবে উৎপন্ন একটি আরডিটি কলকিট রয়েছে, যা দেশের আমদানি নির্ভরতা হ্রাস করবে এবং ভবিষ্যতে কলেরা ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোয় রফতানির সুযোগ তৈরি করবে। এর মধ্য দিয়ে প্রাচীন এ রোগের মোকাবেলা এখন স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত কলেরা প্রতিরোধক উপকরণ, যেমন কলেরা টিকা এবং দ্রুত রোগ নির্ণয় করার কিট-এর মাধ্যমে সম্ভব হবে।’
কলকিটের গবেষণাগার ও মাঠ পর্যায়ের পরীক্ষা-সংক্রান্ত একটি নিবন্ধ সম্প্রতি বিজ্ঞানভিত্তিক জার্নাল ‘প্লস নেগলেক্টেড ট্রপিক্যাল ডিজিজেস’-এ প্রকাশিত হয়েছে। এতে দেখা যায় যে, মাঠ পর্যায়ে ভিব্রিও কলেরি নির্ণয়ের ক্ষেত্রে কলকিটের সংবেদনশীলতা ও নির্দিষ্টতা বিদেশি আরডিটি’র অনুরূপ। এ মূল্যায়ন প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে মোট ৭ হাজার ৭২০ জন রোগীর মলের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। যেখানে দেখা গেছে, কলকিটের সংবেদনশীলতা ৭৬ শতাংশ ও নির্দিষ্টতা ৯০ শতাংশ এবং অন্যান্য প্রচলিত আরডিটি’র ক্ষেত্রে এগুলো ছিলো যথাক্রমে ৭২ ও ৮৬ দশমিক ৮ শতাংশ।
কলেরা নির্ণয়ের ক্ষেত্রে একটি উৎকৃষ্ট মান হলো, গবেষণাগারে মল কালচার পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিতকরণ, যা নমুনা তৈরি, পরিবহনে বিলম্ব, দক্ষকর্মী, সময় (২৪ থেকে ৭২ ঘণ্টা) এবং ব্যয়ের (নমুনা প্রতি ৬ থেকে ৮ মার্কিন ডলার) মতো বিষয়ের প্রতি সংবেদনশীল।
জনস্বাস্থ্য খাতের পরিপ্রেক্ষিতে, কলেরার প্রাদুর্ভাব মোকাবেলার জন্য অবিলম্বে রোগনির্ণয় একান্ত অপরিহার্য, কারণ কলেরা জীবাণু খুব দ্রুত ছড়িয়ে অল্প সময়ের মধ্যেই মহামারীর আকার ধারণ করতে পারে। তাই জনস্বাস্থ্য বিবেচনায় অগ্রাধিকার পায় দ্রুততম সময়ে সঠিকভাবে রোগ চিহ্নিত করতে সক্ষম, সাধারণ ও সাশ্রয়ী এবং সহজে সংরক্ষণ করা যায় এমন একটি পদ্ধতি। ডিপস্টিক পরীক্ষা পদ্ধতি তেমনই একটি পদ্ধতি।
মহামারী প্রবণ এলাকা ও আশপাশের স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোতে দ্রুত রোগের প্রাদুর্ভাব শনাক্তকরণ, রোগের মৌসুমভিত্তিক ব্যাপকতা পর্যবেক্ষণ এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা পর্যায়ে কলেরা জরিপের ক্ষেত্রেও এটি ব্যবহারে ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানিয়েছে আইসিডিডিআরবির বিশেষজ্ঞরা।
আইসিডিডিআরবি সূত্রে জানা যায়, বিশ্বব্যাপী প্রায় ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন মানুষ এ-রোগের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে, যার সিংহভাগ রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ায়। বাংলাদেশে প্রায় সাড়ে ৬ কোটি মানুষ কলেরা ঝুঁকিতে রয়েছে। এ-রোগটির জন্য প্রধানত ভিব্রিও কলেরি নামের একটি জীবাণু দায়ী, ভিব্রিও কলেরি’র ২০০ ও বেশি সেরোটাইপ রয়েছে। সেরোগ্রুপ ‘ও১’ এবং ‘ও১৩৯’ রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু এবং এগুলো মহামারী ও রোগের আঞ্চলিক প্রাদুর্ভাবের জন্য দায়ী। তবে, গত দশকে ভিব্রিও কলেরি ‘ও১৩৯’-এর কারণে কোনো মহামারী ঘটেনি, কেবল রোগের কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা দেখা গেছে। কলকিট ভিব্রিও কলেরি সেরোগ্রুপ ‘ও১’ শনাক্তকরণে অত্যন্ত কার্যকর। এটির উৎপাদন আনুষ্ঠানিক অনুমোদন পেয়েছে; এটির মূল্য প্রায় ৩ মার্কিন ডলার।
আইসিডিডিআরবি এবং রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) যৌথ ব্যবস্থাপনায় বর্তমানে ইনসেপ্টার উৎপাদিত কলকিট বাংলাদেশের ২২টি কলেরা জরিপ সাইটে ব্যবহৃত হচ্ছে।
বাংলানিউজ২৪