২৫ মার্চ ২০২০: বাংলাদেশী চিকিৎসকদের কাল রাত

২৬ মার্চ ২০২০:

ডা. অনুজ কান্তি দাস
এসিস্ট্যান্ট রেজিস্ট্রার, সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল

নতুন দিন – নতুন সূর্য। মহান স্বাধীনতা দিবস। কালকের ২৫শে মার্চটা আসলে চিকিৎসক হিসেবে ভয়াল কাল রাতের মতনই গেছে। দুপুরে শুনলাম রাজবাড়িতে ডিউটি থেকে ফেরার পথে এক চিকিৎসককে পরিচয় জানার পরেও থানার এক ওসি প্রহার করেছে। সন্ধ্যার পর তো পরপর দুইটা নির্দেশ – একটাতে বলা হয়েছে সুরক্ষা পোষাক (পিপিই) না থাকলেও ডাক্তারদের করোনাসহ সকল ব্যক্তিকে চিকিৎসা দিতে হবে। ২য় নোটিশতো আরও অপমানজনক- পুলিশ প্রশাসন আর সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে এটা বাস্তবায়নে।

এমন একটা ক্রান্তি লগ্নে এমন নোটিশ!!! করোনা আতংক নিয়ে এদেশের ডাক্তাররা কি চিকিৎসা বাদ দিয়ে দিয়েছেন?

আচ্ছা – করোনা যখন সারাবিশ্বে আতংক ছড়িয়েছিল- সব দেশ যখন ফ্লাইট বন্ধ করে দিয়েছিল- তখনও আমাদের দেশে প্রতিনিয়ত চীন, ইটালি থেকে লোক আসছিল- আমরা কি বেসামরিক বিমান পরিবহন মন্ত্রনালয় থেকে এদেরকে ভর্তসনা করে কোন স্মারক দেখেছ?

সারা বিশ্বে হোম কোয়ারেন্টাইনে বাধ্য করা হয় – আমাদের দেশে হোম কোয়ারেন্টাইনের নামে লোকজন দেদারসে ঘুরাঘুরিতো করতেছেই সাথে তারা সামাজিক যোগাযোগ এমনকি বিবাহ পর্যন্ত করেছে – আমরা কি জনপ্রশাসন মন্ত্রনালয় থেকে এদের ভর্তসনা করে কিংবা কোন প্রকার হুমকি দিয়ে কোন স্মারক দেখেছি?

অনেক জায়গায় চিকিৎসকদের বাসা বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হচ্ছে- বাসা ছেড়ে দেয়ার নোটিশ দেয়া হয়েছে- এ নিয়ে কি গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে কোন অপমানজনক প্রজ্ঞাপন দেয়া হয়েছে?

সারাদেশে গণজমায়েত নিষিদ্ধ – তারপরেও কয়েক জায়গায় নির্বাচন হয়েছে – আমরা কি নির্বাচন কমিশনকে কেন নির্বাচন সংগঠিত করে করোনা ছড়িয়ে দেয়া হল এরকম হুমকি দিয়ে কোন প্রজ্ঞাপন দেখেছি?

দুই দিন আগে ঘোষনা দিয়ে ১০ দিনের ছুটি দেয়া হল- সেই নোটিশে লোকজন সকল গণপরিবহন দিয়ে লাখে লাখে লোক নিজের এলাকায় চলে গেল- আমরা কি সড়ক, পরিবহন ও সেতু মন্ত্রনালয় থেকে এমন কোন অপমানজনক আদেশ পেয়েছি?

হাসপাতাল থেকে সেবা দিয়ে বাসায় ফেরার সময় নিজের সরকারী কর্মকর্তা পরিচয় দেয়ার পরেও থানার ওসির ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এমন কোন প্রজ্ঞাপন কি দেখেছি?

এতো কোটি কোটি টাকার বাজেট হয় – আমরা ঘোষনা দেই যুক্ত্ররাষ্ট্রের করোনা মোকাবিলায় আমরা সহায়তা করব – আমরা সার্কে সহায়তা করি- তারমানে আমাদের অর্থনৈতিক কোন কমতি নাই। তারপরেও যে পিপিই একবার পড়ে ফেলে দেয়ার কথা- যে পিপিই আমাকে সেফ করার কথা- সেই পিপিই একটাই দিনের পর দিন ব্যবহার করতে বলা- গুনগত মান নিয়ে প্রশ্ন উঠানো মত পিপিই দেয়া – এগুলো তো অনেক বেশি চাওয়া- নিদেনপক্ষে একটা পিপিই সরবরাহ করতে না পারা – আমরা কি অর্থ মন্ত্রনালয়কে এই মর্মে অপমান করে কোন প্রজ্ঞাপন দেখেছি?

বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে এই মহামারীকে মোকাবিলায় কোন সুষ্ঠু পরিকল্পনা না থাকার পরেও কি আমরা পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় থেকে এমন অপমানজনক কোন প্রজ্ঞাপন দেখেছি?

সারাদেশে গণজমায়েত নিষিদ্ধ- সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করার জন্য সেনাবাহিনী নামানো হল- তাদের চোখের সামনে দিয়ে একজন নেত্রীকে মিছিল করে সারা শহর ঘুরানো হল- এজন্য প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে আমরা কি কোন প্রজ্ঞাপন দেখেছি?

এঁকেছেন ক্ষুদে শিল্পী সূত্র চাকমা

এবার আসি চিকিৎসা সেবায় –

– আচ্ছা পিপিই ছাড়াই কি আমরা প্রথম থেকেই ডিউটি করছি না?

– নাকি না দিলে কাজ করব না বলে সবাই কাজ বাদ দিয়ে দিসি?

– ইন্টার্নরা একটা অংশ চিকিৎসা সেবার- ওরা স্ট্রাইকে যাবার পরে কি চিকিৎসা কার্যক্রম এক সেকন্ডও বন্ধ ছিল?

– পিপিই সাপ্লাই দেয়ার পর ওরা যোগদান করতে কি একটা সেকেন্ড দেরী করেছিল?

– কয়টা হাসপাতাল থেকে আপনারা অভিযোগ পেয়েছেন?

– ওসমানীতে চিকিৎসা দিবে না বলার পরে গাইনী বিভাগ কাজে যেতে আধা ঘন্টার বেশি কি দেরি করেছিল? সবাই মিলে লোকালিই উনাদের ম্যানেজ করা হয় নাই? এসময় একজন রোগিও কি আনএটেন্ডেড ছিল?

– নিউমোনিয়া নিয়ে অনেক রোগী ভর্তি হোন – ডাক্তার, নার্সরা আতংকে থাকেন। অতি আতংকিত হবার কারণে অথবা অনভিজ্ঞতার কারণে কয়েকজনকে কিভাবে দেখা উচিত সেটা ভাবতে গিয়ে কেউ কেউ হয়ত মাঝে মাঝে একটু অপারগতা প্রকাশ করেছেন- নিজের সেফটিতো বুঝতে হবে- সেগুলো কি আমরা নিজেরাই সমাধান করি নাই? আতংকিত হওয়া, নিজের সেফটি নিয়ে ভাবা, নিজের পরিবারকে সংক্রমনমুক্ত রাখা – ডাক্তার হয়েছি বলে কি এগুলো বিসর্জন দিয়ে এসেছি? বিসর্জন দিয়েই কিন্তু কাজে আছি।

– আপনাদের এতো অপমানজনক প্রজ্ঞাপনের পরেও কোথাও কি কোন চিকিৎসা সেবা বন্ধ হয়েছে কাল থেকে?

এবার অন্য দেশের রাষ্ট্রনায়কদের কয়েকটা উক্তি শোনাই

– ডাক্তার ও নার্সদের ভূমিকার প্রশংসা করলেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা

– কোভিড-১৯ মোকাবিলায় উদয়াস্ত পরিশ্রমকারী সকল চিকিৎসককে জানাই ধন্যবাদ- পশ্চিমবং সরকার

– করোনা সংকটের সময় সাদা পোশাকে যারা রয়েছেন তারা ঈশ্বরেরই নামান্তর – নরেন্দ্র মোদী

এতোকিছুর পরেও এতো সংকটময় মূহুর্তে যেসময় আমাদের সবার একসাথে থাকার কথা, যেটা মোকাবিলায় আমাদের চিকিৎসকদের আন্তরিকতা সবচেয়ে বেশি, কিভাবে সীমিত যোগান দিয়ে সর্বোচ্চ সেবা দেয়া যায় সেটা নিয়ে যখন সবাই একসাথে ঝাপিয়ে পড়েছেন, যেখানে বিনা পয়সায় কয়েক হাজার মেডিকেলের ছাত্ররা ভলান্টিয়ার ওয়ার্কে করে যাচ্ছেন করোনার বিরুদ্ধে, সেখানে বীরত্ব প্রকাশক কিছু বলার আশা করি না; কারণ এটা আমাদের কর্তব্য। কিন্তু মনের সাহস যোগানোর তো কিছু বলা যেত! তা না বলে উল্টা আমাদের মানসিকভাবে চরম দুর্বল করে দিলেন এসব প্রজ্ঞাপন দিয়ে। আসলে শিক্ষা, চিকিৎসা ও প্রকৌশলী ক্যাডারে এসে সবাই কেমন জানি মেরুদন্ডহীন হয়ে যান। তাই এদের নিয়ে সবাই খেলতে মজা পায়। এই যেমন শিক্ষা ক্যাডারের দুইজনকে অমূলক নির্দেশ দেয়া হল। এই মূহুর্তে এগুলো করে কি লাভ!

ম্যাডাম ও স্যার- আমরা জানি আপনারা উপরের নির্দেশে কাজ করেছেন। আপনারা বলবেন আপনারা শুধু সই করেছেন। কিন্তু একটা সই আমাদের মনোবল ধবংস করে দিয়েছে। একটা সই আমাদের সংক্ষুব্ধ করেছে, আমাদের অপমানিত করেছে। আপনাদের এই নির্দেশগুলো মিডিয়াতে ফলাওভাবে প্রচার হয়েছে। আমরা শুনেছি এই নির্দেশ ওয়েবসাইটে থেকে তুলে নেয়া হয়েছে, কিন্তু জনগণতো নির্দেশনা পেয়েই গেছে। নতুন নির্দেশনা মিডিয়াতে প্রচার হবে না। কারণ ঐটার সংবাদ ভ্যালু খুব কম হবে। তারপরেও আমরা চাই-

– উক্ত প্রজ্ঞাপন বাতিল করে আবার প্রজ্ঞাপন জারি (প্রজ্ঞাপন বাতিল করা হয়েছে)

– অবমাননাকর প্রজ্ঞাপনের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করে প্রজ্ঞাপন ও মিডিয়াতে প্রচারণা

– এমনতর প্রজ্ঞাপনের পেছনে কর্মকর্তাদের অতিসত্বর মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর থেকে অপসারণ

জানি এতক্ষনে হয়ত রাগ প্রশমন হয়ে গেছে। মন অনেক যুক্তি বানিয়ে ফেলেছে। অনেকে অনেকভাবে প্রভাবিত করে ফেলেছে।

Platform

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

দক্ষিণ কোরিয়ায় কোভিড-১৯ ছড়ানো পেশেন্ট ৩১

Fri Mar 27 , 2020
“Don’t be patient 31” কথাটার মানে বোঝেন? দক্ষিণ কোরিয়া পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত দেশগুলোর একটি। সেই দেশেও করোনাভাইরাস ছড়িয়েছে দাবানলের মত। কিভাবে? একটু পিছে তাকিয়ে দেখা যাক। দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রথম করোনাভাইরাস ধরা পড়ে জানুয়ারির ২০ তারিখে, একজন ৩৫ বছর বয়স্ক নারী উহান থেকে সিউল বিমানবন্দরে অবতীর্ণ করলে। তাকে সঙ্গে সঙ্গে সেলফ […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo